ভোটের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সংশয় বিএনপিতে
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাসের ৮ মাস পূর্ণ হলো আজ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন। পরে তাকে আদালতের পাশে নাজিমউদ্দিন রোডের ২২৮ বছরের পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে আট মাস ধরে জেলে আছেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও নেতারা আশা করছেন আর মাত্র দু’টি মামলায় জামিন পেলে কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আইনগত বাধা অপসারিত হতে পারে। এ পর্যন্ত বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৬টি মামলার মধ্যে ৩৪টিতে জামিন লাভ করেছেন তিনি। এখন কুমিল্লার আদালতে দুইটি মামলায় জামিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। একটি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ও দায়রা জজের বিচারক কে এম সামছুল আলম ১২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন। অপর মামলাটির জামিন আবেদনের ওপর শুনানির দিন নির্ধারনের জন্য ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে আবেদন করবেন বেগম জিয়ার আইনজীবীরা। খালেদা জিয়ার আইনজীবী একেএম এহসানুর রহমান জানান, কুমিল্লার নাশকতার মামলায় আগামী ১২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জামিন শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে। আর অপর একটি হত্যা মামলায় দায়রা আদালত থেকে নথি আসা সাপেক্ষে কুমিল্লার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। তার আইনজীবী মাসুদ আহমদ তালুকদার ইত্তেফাককে জানান, তারা হত্যা মামলার দ্রুত জামিন শুনানির জন্য আগামীকাল রবিবার পিটিশন দিবেন।
এদিকে কুমিল্লার অবশিষ্ট দুই মামলায় জামিন পেলে বেগম জিয়া কারামুক্ত হতে পারবেন কি-না তা নিয়ে সংশয়ে আছেন দলের আইনজীবী ও নেতৃবৃন্দ। দলের সিনিয়র একজন আইনজীবী নেতা ইত্তেফাককে বলেন, সরকার আন্তরিক না হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে মুক্ত করা সম্ভব না। দুইটি মামলায় জামিন হলে উনার মুক্তি মিলবে এমন আশা ভেঙে গেছে কারাগারের ভেতর আদালত স্থাপনের পর। আমরা ধারণা করেছিলাম সরকার কিছুটা নরম হয়েছে। কিন্ত তা ঠিক নয়। তারা বেগম জিয়ার ব্যাপারে হার্ডলাইনে আছে বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত তাকে কারাগারে রাখার ষড়যন্ত্র চলছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আমরা আইনজীবীরা আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। যতবার সফলতার দোরগোড়ায় গেছি তখনই সরকারের কলাকৌশল আর ষড়যন্ত্রের কারণে জামিন বিলম্বিত হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভবপর নয়। একমাত্র পথ হলো, রাজপথ। এই রাজপথে যাওয়ার জন্য এখন প্রস্তুতি নিচ্ছি।
স্থায়ী কামটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, এখন যা পরিস্থিতি তাতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আইন যখন সরকারের হাতে চলে যায়, তখন তো আর ন্যায়বিচার আশা করা যায় না। বিচারবিভাগকে সরকার প্রভাবিত করছে তাই দেশের মানুষ মনে করে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়। আমরাও মনে করি আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না। এর জন্য আন্দোলন সংগ্রাম, প্রতিবাদ, প্রয়োজন। বিএনপি তাই খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমীর খসরু বলেন, আর দুইটি মামলায় জামিন পেলেই তিনি মুক্তি পাবেন বলে আমরা আশা করতে পারি, তবে নিশ্চিত হতে পারি না। কারণ সরকার বেগম জিয়াকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র করছে। তাকে মাইনাস করে নির্বাচন করতে চায়। নির্বাচনের আগে তার মুক্তি এমনিতে দিবে না। এজন্য আমাদের আন্দোলন করতে হবে। সরকারকে আমরা বাধ্য করবো।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আইনের প্রক্রিয়ায় যদি জামিন হয় তাহলে আমরা আশা করি অতি শিগগিরই তিনি কারামুক্ত হবেন। আমরা আশা করছি কুমিল্লার দুইটি মামলায় জামিন হলে তার কারামুক্তিতে আইনগত বাধা থাকবে না। এখন রাজনৈতিকভাবে সরকার খালেদা জিয়াকে আরো মামলা দিয়ে বা গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত জেলে রাখতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। যদি তাই হয়, তাহলে সেটা হবে অত্যন্ত বেআইনি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চারটি মামলা ছাড়া বাকি সব মামলা দায়ের করা হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। রাজনৈতিকভাবে এখন সরকার খালেদা জিয়াকে আরো মামলা দিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত জেলে রাখতে পারে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। তার বিরুদ্ধে যে সব মামলা রয়েছে তাতে এই সময়ে এই মামলায় (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা) তাকে গ্রেপ্তার করার কোনো কারণ ছিল না।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ও বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, যে মামলায় খালেদা জিয়া জেলে গেছেন সেই মামলায় কিন্তু তিনি জামিনে আছেন। কিন্তু কিছু বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলায় তাকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় জামিন পাওয়ার অর্থই হচ্ছে তিনি মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপে কারামুক্ত হতে পারছেন না। তাকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা মনে করি সরকারের হস্তক্ষেপেই আইন চলছে। তিনি বলেন, সরকার গোপনে অনেক কিছু করছে, যা আমাদের জানানো হচ্ছে না। এসবই করা হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যাতে তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যায়।
এডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, কুমিল্লার দুই মামলায় জামিন পেলে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে আর কোন বাধা থাকবে না। তবে আমাদের আশংকা সরকার যদি তাকে নির্বাচন পর্যন্ত কারাগারে রাখতে চায় তাহলে হয়তো নতুন কোন মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখাতে পারে। সরকারের মনোভাব সুবিধাজনক নয়।
কুমিল্লার জামিনের অপেক্ষায় থাকা দুই মামলার ব্যাপারে আইনজীবিরা জানান, ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সদরের পৌর এলাকার হায়দারপুল নামক স্থানে একটি কাভার্ডভ্যানে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। পর দিন ২৬ জানুয়ারি চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে থানায় বিএনপি চেয়ারপারসনসহ ২০ দলীয় জোটের ৩২ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। এরই মধ্যে আদালতে মামলাটির অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। ওই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগসহ তাকে হুকুমের আসামি করা হয়।