হিরোশিমার শান্তি সারস
জাপানে জনশ্রুতি রয়েছে কেউ যদি এক হাজার কাগজের সারস তৈরি করতে পারে তবে তার মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। হিরোশিমা’র আণবিক বোমার শিকার ১২ বছরের সাদাকো সাসাকি বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে কাগজের হাজার সারস তৈরি করেছিলো কিন্তু ১৯৫৫ সালে সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সারা বিশ্বের শিশুদের বইয়ে সাসাকি’র করুণ কাহিনী সুপরিচিত হয়ে ওঠে।
দুই ব্যক্তির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ বছর সাদাকো’র একটি সারস প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি আগে সাসাকি’র তৈরি ছোট্ট সারস তার ভাই মাসাহিরো সাসাকি আমেরিকার মিসৌরি রাজ্যের একটি লাইব্রেরিতে দান করেছেন। লাইব্রেরিটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান’র সম্মানে নির্মিত হয়েছিলো, যিনি ১৯৪৫ সালে জাপানে আণবিক বোমা নিক্ষেপের অনুমোদন দিয়েছিলেন।
“এটি আমাকে আনন্দে ভরিয়ে দিচ্ছে” মাসাহিরো বলেন “সত্যিই আমার পক্ষে এরচেয়ে খুশী হওয়া সম্ভব নয়”। ট্রুম্যান’র নাতি ক্লিফটন ট্র্যুম্যান ডানিয়েল এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। তিনি বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, তার হস্তক্ষেপেই লাইব্রেরির কর্মকর্তারা সারসটিকে সেখানে প্রদর্শনের জন্যে গ্রহণ করেন।
হ্যারি ট্রুম্যান’র সবচেয়ে বড় নাতি হিসেবে ড্যানিয়েল মহান গর্ব অনুভব করে আসছিলেন। তিনি তার উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করার জন্যে দিনরাত কাজ করেছেন। কিন্তু ১৬ বছর আগে তার পুত্র সাদাকো সম্পর্কে একটি বই বাসায় আনলে তার চিন্তাভাবনা ওলট-পালট হয়ে যায়।
ড্যানেল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন কেমন করে একটি ছোট শিশুর কাহিনী তার উপর বড় রকমের প্রভাব ফেলে। “আমার পিতামহ সব সময়েই বলতেন আণবিক বোমার ফলে যুদ্ধ স্বল্প স্থায়ী হয়েছিলো এবং বহু আমেরিকানের জীবন বেঁচে গিয়েছিলো। সত্যিই তা সব কিছুর মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বইটি পড়ে আমি আণবিক বোমার শিকার একজন মানুষের অনুভুতির কথা জানতে পারি।”
ড্যানিয়েল আণবিক বোমায় বেঁচে যাওয়াদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন তিনি সাদাকো’র ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। ২০১০ সালে সাদাকো’র ভাই জাপান সফর করেন। “সবচেয়ে প্রথমে আমি ড্যানিয়েলকে জিজ্ঞেস করি যখন তুমি জানতে পারো তোমার পিতামহ এসবের জন্যে দায়ি তখন তোমার কেমন অনুভূতি হয়েছিলো?” মাসাহিরো বলেন “সে আমায় উত্তর দেয় কিছু সময়ের আমাকে তা পীড়া দিতে থাকে”।
সাসাকি ডানিয়েলকে একটি ছোট্ট উপহার দেন।
“সে একটি ছোট্ট কাগজের সারস বের করে, আমার হাতের তালুতে রেখে বলে এটিই ছিলো শেষ সারসটি যা মৃত্যুর আগে সাদাকো ভাঁজ করে গেছে” ড্যানিয়েল বলেন “আর সে সময় তিনি আমাকে হিরোশিমা ও নাগাসাকি সফর করতে বলেন ….আমি আর না বলতে পারিনি। সাদাকো এবং সারস গল্পের অনেক শক্তি”।
দু’বছর পর ড্যানিয়েল হিরোশিমা ও নাগাসাকি সফর করেন। লোকজন যখন জানবেন তার পরিচয় তখন তারা কী করবেন তা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন।
কিন্তু আণবিক বোমায় বেঁচে যাওয়া মানুষরা কেউ তাকে কোনো দোষারোপ করলেন না কিম্বা ক্ষমাও চাইতে বললেন না। তারা শুধু পৃথিবীর আর কোথাও যেন আণবিক বোমা ফেলা না নয় -তার নিশ্চয়তা চাইলেন।
“দু’পক্ষেরই ক্ষতি হয়েছে” ড্যানিয়েল বলেন। “দু’পক্ষের মানুষরাই কষ্ট সহ্য করেছেন এবং যদি উভয় পক্ষই তা মেনে নেয় তবে পারষ্পরিক সমবেদনা আর উপলব্ধি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে, এভাবেই এগিয়ে যেতে হয়”।
গত মাসে সাসাকি যখন আমেরিকা গিয়েছিলেন সারস উপহার দিতে তিনি এবং ড্যানিয়েল মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন।
এক শিক্ষার্থী মাসাহিরো’কে প্রশ্ন রাখেন “অনেকের বিশ্বাস আণবিক বোমাই ছিলো যুদ্ধ শেষ করার একমাত্র পথ -এ সম্পর্কে তোমার মত কী”?
মাসাহিরো জবাবে বলেন “ঘটনা সম্পর্কে আমেরিকান শিক্ষা আর জাপানি শিক্ষার যে পার্থক্য সেটা বোঝাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ”।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৭০ বছর পার হলো, সাদাকো’র ছোট্ট একটি প্রতীক মার্কিন ও জাপানি জনগনকে কাছে এনে দিয়েছে এবং পারষ্পরিক সৌহার্দের পথ দেখাচ্ছে।