আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে -হুম্মাম কাদের চৌধুরী

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে নির্দোষ দাবি করে তার পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেছেন, ‘আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, রাত ৮টায় বলা হয় এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের দেখা করতে। সরকার প্রাণভিক্ষা চেয়েছে বলে নাটক করছে। আমরা উনার সাথে কারাগারে দেখা করতে গেলে তিনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তির কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইব না। প্রাণভিক্ষা চাইলে আল্লাহর কাছে চাইব। গতকাল (রোববার) রাতে নগরীর গুডস হিল বাসভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী এসব কথা বলেন। হুম্মাম কাদের বলেন, বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল তাকে রাঙ্গুনিয়ায় দাফনের। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে দিল না সরকার। বাবা কয়েকদিন আগে ত্রুটিপূর্ণ বিচারের জন্য প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রেসিডেন্টের কাছে পিটিশন দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমাদের পিটিশন গ্রহণ করা হয়নি। হুম্মাম কাদের বলেন, আমরা বাংলাদেশের একটি বড় সম্পদ হারিয়েছি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো লোক আমরা ফিরে পাব না। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের দোয়া করবেন। সত্য ঘটনা একদিন বের হয়ে আসবে। তিনি নির্দোষ ছিলেন। মানুষ বলবে তাকে মার্ডার করা হয়েছে। তিনি সত্য ঘটনা বের করার জন্য সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, আমার বাবাকে চট্টগ্রামবাসী যে সম্মান দিয়েছেন তা আজীবন মনে রাখব। হুম্মাম কাদের বলেন, আমরা যখন কারাগারে তার সাথে দেখা করতে যাই তখন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, কি হলো, আজকে কি আমাকে মেরে ফেলবে। পরিবারকে দেখে তিনি খুশি হয়েছিলেন। আমাদের সাহস দিয়েছেন। প্রাণভিক্ষা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা মানুষ কি কারও কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারে। তোমরা কি বিশ্বাস কর। এ সরকার অনেক কাগজ বানাতে পারে। সংবাদ সম্মেলনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী বলেন, পাগলেও বিশ্বাস করবে না আমার স্বামী ক্ষমা চাইতে পারে। আমরা পরিবার ও দলের সিদ্ধান্তক্রমে  প্রেসিডেন্টের কাছে শুধু রি-ট্রায়ালের জন্য পিটিশন দিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা যখন তার সাথে দেখা করতে যাই তখন তিনি ছিলেন অবিচল এবং দৃঢ়চেতা। তার সাথে আমরা গল্প-গুজব করে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমার বড় ভাইয়ের ঈমানি শক্তি ছিল প্রবল। তিনি শুধু স্ত্রীকে বলেছেন, আমাকে মাফ করে দিও। আমি রাজনীতি করতাম, তোমাকে সময় দিতে পারিনি। মৃত্যুর তিন ঘণ্টা আগেও তার মধ্যে ভয়ভীতি ছিল না। তিনি বলেছেন, আমি ভুল করিনি, অন্যায় করিনি, অপরাধ করিনি। এছাড়া তিনি কাফনের কাপড় এবং গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি জেলারকে বলেছিলেন, তাকে রাঙ্গুনিয়া দাফনের জন্য। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সরকার তাকে রাউজানে দাফন করতে বাধ্য করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ২ কন্যাসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয় ও বিএনপি নেতা। রাউজানে দাফন : জানাযায় উপস্থিতি কমাতে নানা অপকৌশল রাউজান থেকে এম বেলাল উদ্দিন জানান, কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে বিপুল মানুষের অংশগ্রহণে রাউজানের গহিরায় বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল (রোববার) সকাল ৯টা ২২ মিনিটে বক্স আলী চৌধুরী বাড়ী জামে মসজিদের উত্তর পাশে খালি জায়গায় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ফটিকছড়ি বাবু নগর মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল শায়খুল উলামা হযরত মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। জানাযায় ১১ কাতার মানুষ অংশ নেয়। একেকটি কাতারে ৫০ জনেরও বেশি মুসল্লিকে দাঁড়াতে দেখা যায়। জানাযা শেষে স্থানীয় রীতি অনুযায়ী উপস্থিত মুসল্লীদের জিজ্ঞেস করা হয়, ‘এই লোকটি কেমন ছিলেন? সকলে এক বাক্যে বলে ওঠেন ওনি খুব ভালো লোক ছিলেন।’ এরকম ৩ বার উচ্চারণ করা হয়। এর পর খাটিয়া করে লাশ পারিবারিক কবরস্থানে নেয়া হয়। তারপর ৯টা ২৮ মিনিটে যখন সালাউদ্দিন কাদেরের লাশ খাটিয়া থেকে নামিয়ে কবরে শোয়ানো হয় তখন আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা ডুকরে কেঁদে উঠেন। উচ্চস্বরে তকবির ধ্বনি ও কালেমা পাঠের মধ্যদিয়ে লাশ কবরে নামানো হয়। পুলিশের তাগাদার কারণে মাত্র ২৭ মিনিটের মধ্যে দাফনের কাজ সমাপ্ত হয়। তাদের পৈতৃক বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে সালাউদ্দিন কাদেরের ছোটভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। ৯টা ৫৫ মিনিটে দাফন শেষে মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। এরপর দিনভর তার স্বজন, ভক্ত ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নীরবে এসে কবর জেয়ারত করেন। কেউ দূর থেকে দোয়া-দরূদ পাঠ করেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নামাজে জানাযায় তার ছোট ভাই ফজলুল কাদের চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র শিল্পপতি আলহাজ জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী, ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী ফায়াজসহ নিকট আত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীরা শরিক হন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী নামাজে জানাযায় উপস্থিত ছিলেন না। জানা যায়, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভাইয়ের জানাযায় আসতে পারেননি। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে জানাযা ও দাফন অনুষ্ঠানকালে ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার কয়েকশ’ সাংবাদিককে অনেক দূরে ঘেরাও করে রাখে পুলিশ। এদিকে লাশ দাফন ও জানাযাকে কেন্দ্র করে প্রায় সাড়ে তিনশ’ পুলিশ, ২ প্লাটুন বিজিবি ও ২ প্লাটুন র‌্যাব গহিরাসহ বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন ছিল। নামাজে জানাযার আগে সকাল ৮টা থেকে গহিরা-মোবারখীল সড়ক ও গহিরা-অদুদিয়া সড়কে যান ও জনচলাচল একেবারে বন্ধ করে দেয় পুলিশ। সূত্র জানায়, নিরাপত্তার কারণে আগামীকালও গহিরায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ী এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকবে। মানবতা বিরোধী অপরাধে দ-িত ফাঁসির আসামী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে কার্যকর করা হয়। এর পর কারাগারের সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে লাশবাহী এম্বুলেন্স যোগে সালাউদ্দিন কাদেরের লাশ নিয়ে রওনা হন রাউজানের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে লাশের গাড়ি পৌঁছে রাউজানের পৈতৃক বাড়িতে। এ সময় পথে পথে জনতা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও কোথাও পুলিশ লোকজনকে ধাওয়া করে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলেসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা কয়েকটি মাইক্রোযোগে সকাল ৮টা ৪১ মিনিটে গহিরা চৌমহনীতে এসে পৌঁছান। লাশবাহী এম্বুলেন্সসহ প্রায় ৩০টি র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির গাড়ী কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গহিরা চৌমহনী অতিক্রম করে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুরান বাড়ীর সামনে লাশবাহী গাড়ীটি গিয়ে থামান। প্রশাসন সেখানে জানাযা আয়োজন করতে চাইলেও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলের বাধার কারণে তা হয়নি। ছেলে হুম্মাম কাদেরের ইচ্ছা অনুযায়ী লাশবাহী গাড়িটি সেখান থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লাশের দায়িত্বে থাকা ঢাকার এক পুলিশ অফিসার’র কাছ থেকে লাশ গ্রহণ করে রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করেন ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। জানাযায় শরিক হতে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসে। কিন্তু পুলিশের লুকোচুরির কারণে অনেকে জানাযায় শরিক হতে পারেননি। সকাল থেকে অসংখ্য মুসল্লি যখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ীতে নামাজে জানাযা পড়ার আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসছিল, তাদেরকে পুলিশ জানাযা গহিরা উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বলে সে দিকে পাঠিয়ে দেয়। গহিরায় যখন কয়েকশ’ মানুষ একসাথে জড়ো হয় তখন তাদের বলা হয় জানাযা হবে বাড়ীতে। সে জন্য অনেকেই জানাযা নামাজে শরিক হতে পারেনি। রাউজানের গহিরা-চৌমুহনী-চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কে কয়েকশ’ পুলিশ এক ধরনের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। সে বলয়ের মধ্যে গহিরা-মোবারখীল সড়ক ও গহিরা-অদুদিয়া সড়কে যান চলাচল একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়। দেখা যায় পায়ে হেঁটেও কাউকে সড়কের দক্ষিণ দিকে আসতে দেয়া হয়নি। গহিরা চৌমহনীতে সকাল ৭টা থেকে দাফন শেষ হওয়া পর্যন্ত কোন যানবাহনকে অপেক্ষা করতে দেয়নি পুলিশ সদস্যরা। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চায়ের দোকান ছাড়া নিরাপত্তার কারণে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে খুলতে দেয়নি প্রশাসন। নামাজে জানাযা কিংবা দাফন অনুষ্ঠানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দল বিএনপির কোন নেতাকে দেখা যায়নি। এমনকি যারা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে নিয়ে গর্ব করত এমন লোকও তার জানাযা কিংবা দাফনে আসেনি। দাফন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর কয়েকশ’ মানুষ মোবারকখীল সড়ক থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ীতে ঢুকে পড়ে। তাদের মুখে ছিল হায় হায়। তাদের অনেকে উচ্চস্বরে বিলাপ করতে থাকে। রাউজানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর লাশ আনা ও দাফন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে গতকাল তাদের এ ধরনের কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। সকাল থেকে গহিরা চৌমুহনীতে অবস্থান নেন রাউজান পৌরসভার প্যানেল মেয়র বশির উদ্দিন খাঁন। তিনি জানান এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে কেউ যাতে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে সে জন্য আমি এখানে অবস্থান নিয়েছি।