ফেইসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধে দেশ-বিদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া
গত ১৮ নভেম্বর বুধবার দুপুরে সারা বাংলাদেশে অকস্মাৎ ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। ৭০ মিনিট ইন্টারনেট বন্ধ থাকে। তারপর ফেইসবুক, ভাইবার, হোয়াটস্ এ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারসহ সামাজিক যোগাযোগের ৭ টি বা ততোধিক মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ১৫ দিন ধরে এগুলো বন্ধ রয়েছে। এসব যোগাযোগ মাধ্যম কবে খোলা হবে সেটি নিয়ে এক ধরনের চোর-পুলিশ খেলা চলছে। টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এতদিন বলছিলেন যে, মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এবং তাদের জীবন রক্ষা করার জন্যই এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা সংকট কেটে গেলেই এসব বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করা হবে। এখন তিনি বলছেন যে, আমাদেরকে অর্থাৎ তার মন্ত্রণালয়কে খুলে দিতে বললেই তাৎক্ষণিকভাবে তারা এগুলো খুলে দেবেন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন যে, সন্ত্রাসের সংকট এখনো কাটেনি। কেটে গেলেই এগুলো খুলে দেওয়া হবে। ফেইসবুকে চিঠি লেখা দুই মন্ত্রীর এই ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ মন্তব্যের মাঝে গত মঙ্গলবার পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার নাকি ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছেন। তারা নাকি তাদের সাথে বৈঠক করতে চান। সরকার ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে কেন বৈঠক করতে চান, কবে করতে চান, এ সম্পর্কে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। তবে এই খবর থেকে একটি বিষয় ধারণা করা যায় যে, ফেইসবুক বা ভাইবার খুলতে এখনো দেরী আছে। এদিকে পত্র-পত্রিকায় আরও খবর বেরিয়েছে যে, ফেইসবুক একাউন্ট খুলতে ন্যাশনাল আইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। কেউ চাইলে আর প্রচলিত নিয়মে ফেইসবুক খুলতে পারবেন না। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভুয়া একাউন্টধারীদের শনাক্ত করা এবং নতুন করে ভুয়া একাউন্ট খোলা ঠেকানো যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘স্মার্ট ন্যাশনাল আইডি কার্ড প্রকল্প চালু হলে ফেইসবুকের কাছে ইমেইল আইডির সঙ্গে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ভেরিফিকেশনের জন্য নতুন অপশন যোগ করার জন্য আমরা ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখব।’ চিঠিতে বাংলাদেশের পটভূমিতে ফেইসবুকের নানা অপব্যবহার ও নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পটভূমিতে অনেক কিছুই নেতিবাচক মনে করে না ফেইসবুক। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে কোনো বিষয়ে তাদের অভিযোগ জানালে মামলা করে আসতে বলা হয়। তাদের কাছে অভিযোগ জানালেও তারা আমলে নেয় না। ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের এই সামাজিক অবস্থাগুলো তুলে ধরা হবে।’ বিষয়টির গুরুত্ব বাড়াতে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি থেকেও এ ধরনের চিঠি সম্প্রতি পাঠানো হয়েছে। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে ইতোমধ্যেই এসব মাধ্যম বন্ধ করার পর ১৫ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন আবার চিঠি লেখা এবং বৈঠকের কথা বলা হচ্ছে। এসব সম্পন্ন করতে কতদিন লাগবে সেটি একমাত্র সরকারই জানেন। তবে এর ফলে জনমনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটি কেবল বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এখন বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে প্রায় ১ কোটি প্রবাসীর বাস। প্রায় প্রতিটি ঘর থেকেই অন্তত ১ জন বিদেশে বাস করছেন। এরা টেলিফোনে, ই-মেইলে বা অন্যান্য মাধ্যমে জানাচ্ছেন যে, বিদেশে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আর যাই হোক, সেই প্রতিক্রিয়া যে সরকারের অনুকূল নয় সেটি বুঝতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ থেকে বিদেশীরা তো দূরের কথা, বাংলাদেশীরাই বলছেন যে, এসব দেশে এই ধরনের ঘটনা কল্পনাই করা যায় না। দেশের অভ্যন্তরে মানুষ বলছেন যে, ইতোপূর্বে চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক টিভি, দিগন্ত টিভি, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে। এখন আবার ৭ টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা হলো। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে মত প্রকাশের বাহনগুলি স্তব্ধ হওয়া, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচায়ক নয়। এরফলে দেশ একটি বিশেষ পদ্ধতির দিকে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক প-িতরা মনে করেন। গোড়ার কথা গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল, ‘ওঘঞঊজঘঊঞ, গঙইওখঊ অচচঝ / ঝঁফফবহ ংযঁঃফড়হি ভড়ষষড়ংি াবৎফরপঃ.’ ‘ইন্টারনেট, মোবাইল এ্যাপ্স / রায়ের পর অকস্মাৎ বন্ধ’। খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সর্ব প্রথম সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ফলে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসা ও চাকরি বাকরিসমূহ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭৫ মিনিট ধরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পর সরকার ফেইসবুক এবং অনলাইন ম্যাসেজিং বন্ধ করে দেয়। একই সাথে হোয়াটস এ্যাপ এবং ভাইবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ডিজিটাল জগতের বিশেষজ্ঞ এবং উদ্যোক্তারা বলেন, তাদের অনলাইন সার্ভিস বন্ধ থাকার ফলে ডিজিটাল ব্যবসা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব থাকবে দীর্ঘদিন। কম্পিউটার সমিতির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোস্তফা জব্বার বলেন, আধুনিক জীবন, ব্যবসা এবং অফিস-আদালতের লাইফ লাইন হলো ইন্টারনেট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাইট সমূহ ব্লক করা সরকারি মেকানিজমের সর্বাত্মক ব্যর্থতাই প্রমাণ করে। আলোচ্য ইংরেজী পত্রিকাটির রিপোর্ট মোতাবেক সর্বোচ্চ আদালত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের রিভিউ পিটিশন খারিজ করার ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই ইন্টারনেট ব্লক করা হয়। ইতোপূর্বে বিটিআরসি বা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ সংস্থা ফেইসবুক, হোয়াটস এ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, ট্যাংগো এবং ভাইবার বন্ধ করার জন্য সমস্ত মোবাইল কেরিয়ার, ইন্টারনেট গেটওয়ে এবং সার্ভিস প্রভাইডারদের নির্দেশ দেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, অবাধে চ্যাট করার চেয়ে জনগণের নিরাপত্তা অনেক মূল্যবান। গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে বলেন যে, জঙ্গিদের গ্রেফতার এবং তাদের ক্রিমিনাল কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য হোয়াটস এ্যাপ এবং ভাইবার ব্লক করা হতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এ বছরের ১৮ জানুয়ারী ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ, ট্যাংগো এবং মাই পিপল লাইন ৪ দিনের জন্য বন্ধ করা হয়েছিল। বিডিআর ম্যাসাকারের পর সরকার ২০০৯ সালে ২৬০ দিনের জন্য ফেইসবুক এবং ইউটিউব বন্ধ করে দেয়। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক এসব ডিজিটাল সার্ভিস বন্ধ থাকার ফলে ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যাংকিং, আউট সোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং এবং কল সেন্টার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেইসবুক, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপ বন্ধ করার ফলে মোবাইল ডাটার ব্যবহার অনেক কমে গেছে। এছাড়া ব্যান্ড উইডথ ব্যবহার বিপুলভাবে কমে গেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট তথ্য সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করে ফেইসবুক। এমনকি অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের সংবাদ দিতে হয় ফেইসবুকের মাধ্যমে। যদিও সোয়া ঘন্টা পর ইন্টারনেট লাইন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কিন্তু তারপর দেখা যাচ্ছে যে ইন্টারনেট স্পীড বা গতি দারুণভাবে কমে গেছে। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের এক কর্ণধার জানান যে, ভাইবার এবং হোয়াটস এ্যাপ বন্ধ করার ফলে কতগুলো ওয়েব সাইটে ঢোকা যাচ্ছে না। ডাক ও টেলি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানিয়েছেন, ফেইসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস এ্যাপ এবং ভাইবার ছাড়াও টুইটার, ট্যাংগো, আইএমওসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য এ্যাপেও নজরদারি চালানো হচ্ছে। দেশ ও জাতির নিরাপত্তার স্বার্থেই এগুলো বন্ধ করা হয়েছে বলে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন। ইন্টারনেট ও ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এ পর্যন্ত ৭ থেকে ৯ টি সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেইসবুক, ভাইবার, হোয়াটসএ্যাপ, ট্যাংগো, হ্যাঙ্গআউট, ইউস্টার্ন ডট টিভি, কমিউর, লাইন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে তীব্র সমালোচনার যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি প্রযুক্তিবিদরাও এ সিদ্ধান্তের প্রতি দ্বি-মত পোষণ করেছেন। প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারের যে লক্ষ্য তা পূরণ হবে না এবং কোনো সমাধানও আসবে না। এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, একদিন না একদিন তো এসব যোগাযোগ মাধ্যম খুলতে হবে। তখন কি হবে? সরকার যে আশঙ্কায় এগুলো বন্ধ করেছে, তা কি নির্মূল হয়ে যাবে? সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠী কি এসব এ্যাপস ব্যবহার বন্ধ করে দেবে? এতে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হওয়া ছাড়া খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কারণ, ফেইসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যম সংখ্যাগরিষ্ঠ যেসব সাধারণ ব্যবহারকারী ব্যবহার করছে, তারা ইতোমধ্যে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। বিটিআরসি’র হিসাব মতে, দেশে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে শুধু ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। বাকিরা অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করছে। এই বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারী বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ প্রজন্ম মনে করছে, এটা তাদের অবাধ তথ্য আদান-প্রদান ও মতামত প্রকাশের মতো মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। বিশ্বজুড়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন আইএস তার বেশিরভাগ কার্যক্রম ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে যাচ্ছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর ও সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলো তো সেসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করতে পারছে না বা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। কারণ, তারা জানে, প্রযুক্তির এ যুগে তা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক পথ বন্ধ করলে অসংখ্য পথ বের হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া সরকারের ভাবমর্যাদা কোনোভাবেই উজ্জ্বল করছে না। প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন, প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। কোনো এ্যাপস বন্ধ করে নয়।