• Bangla Dailies

    Prothom alo
    undefined
    Songbad
    daily destiny
    shaptahik
  • Weeklies

  • Resources

  • Entertainment

  • Sports Links

  • জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ইন্তেকাল করেছেন

    বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দল জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া..রাজেউন)। আজ রোববার সকাল সাতটার দিকে রাজধানীর আসাদগেটের বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন। শফিউল আলম প্রধান বেশ কিছুদিন ধরে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
    বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা বাদ যোহর আসাদগেটের বাসায়, দ্বিতীয় নামাজে জানাজা বাদ আসর ইকবাল রোডের জামে মসজিদ ও তৃতীয় জানাজা আগামীকাল সকালে বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
    শফিউল আলম প্রধানের মৃত্যুতে ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গভীর শোক জানিয়েছেন বলে জানান শায়রুল কবীর খান।
    এদিকে জাগপা সভাপতির মৃত্যুর খবর পেয়ে তার বাসায় ছুটে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ ২০দলীয় জোটের নেতারা
    মূর্তি অপসারণ চান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরাও

    মূর্তি সরিয়ে ফেলা উচিত -ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  : ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতের সম্ভাবনা- অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার : আশা করি প্রধান বিচারপতি এটা অপসারণ করবেন- অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন
    মালেক মল্লিক : সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে মূর্তি (ভাস্কর্য) অপসারণ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের অধিকাংশ আইনজীবীরা ও কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ৯০ ভাগ মুসলমানের এ দেশে মূর্তি স্থাপন গভীর যড়যন্ত্রের শামিল বলে। জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের সামনে এ রকম মূর্তি বসানো ঠিক হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নকশার কোথাও মূর্তি নেই। দ্রæত সময়ের মধ্যে এটা অপসারণ করতে হবে। সরকার সমর্র্থিত আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীরাও ভাস্কর্য অপসারণে একমত। সুপ্রিম কোর্টের সামনে ‘মূর্তি’ স্থাপন সংবিধানের ১২ ও ২৩ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী উল্লেখ করে রিটও করেন একজন আইনজীবী। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ভাস্কর্যের অপসারণ চান। যা শুনানি অপেক্ষায়।
    এটা অপসারণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম। এদাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আওয়ামী ওলামা লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। গত ১৫ এপ্রিল বিচারপতিদের বাসভবন উদ্ধোধন কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলতে বা ঢেকে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা বিবেচনা করতে প্রধান বিচারপতির প্রতি আহŸান জানান। সর্বশেষ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবীরা মূতি অপসারণে মানববন্ধন করেন।
    এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত গ্রীকদের দেবীর আদলে মূর্তি (ভাস্কর্য) নিয়ে বিভিন্ন মহলে বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে অন্যত্র সরিরে নিলে বির্তক অবসান হবে। এমন তো না অন্য জায়গা সরানো যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। এই ভাস্কর্য মেনে নিতে পারছে না। তিনি বলেন, জাতীয় ঈদগাহের মাঠ সেখানে মুসল্লিরা ঈদের নামায পড়বেন। এইসব বিষয় বিবেচনা করে মূর্তি সরিয়ে ফেলা উচিত। নিশ্চিয় প্রধান বিচারপতি একটা পদক্ষেপ নিবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন সাবেক এই মন্ত্রী।
    বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক আবদুল বাসেত মজুমদার ইনকিলাবকে, আমার দেশটিকে যদিও ধর্মনিপেক্ষ বলা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলমান। এখানে একটা ধর্মীয় সেন্টিমেন্টাল (অনুভূতি) আছে। এটা স্থাপনের ফলে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টাল (অনুভূতি) আঘাতের সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন, আদালতে পাশে আমাদের জাতীয় ঈদগাহের মাঠ; ভাস্কর্যটি স্থাপন করতে সামগ্রীক দিক খেয়াল করা উচিত ছিল। এটা নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। ভাস্কর্যটি অপসারণ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
    সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেস্টা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী ভাস্কর্য সরানো নিয়ে প্রধান বিচারপতি সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে কথা বলেছেন। তাই আশা করি দ্রæত সময়ের মধ্যে এটা সরানো হবে। আইনজীবী নেতা বলেন, প্রধান বিচারপতি নিজেস্ব চিন্তা- চেতনা থেকে এটা স্থাপন করেন; বারের সঙ্গে কোন আলাপ আলোচনা করেনি। আশা করি, সরকার প্রধানে কথা মতো প্রধান বিচারপতি এটা অপসারণ করবেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষে কোন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
    গত বুধবার মূতি অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করে মূর্তি সরাতে প্রধান বিচারপতি প্রতি আহŸান জানান। বক্তারা বলেন, এরকম এটা বসানো যড়যন্ত্রমূলক। ১৯৪৭-৪৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের পর থেকে এখানে কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়নি। প্রায় অর্ধশত আইনজীবীরা মানববন্ধনে অংশ নেন। এ কর্মসূচির প্রতি একমত পোষণ করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থিত আইনজীবীরা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ও জামায়াত পন্থীরাও ওই মূর্তি অপসারণে মত দেন। তাদের মধ্যে একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট একটি পবিত্র স্থান, কিন্তু হঠাৎ করে কেন স্থাপন হলো। এটা নিয়ে আমার নয় সকল আইনজীবীর প্রশ্ন। সুপ্রিম  কোর্টের একজন কর্মচারী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এখানে স্থাপন করা উচিত হয়নি।
    গতবছর ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে মূলভবনের সামনে ফোয়ারার মধ্যে স্থাপন করা হয় মূর্তিটি। এটি স্থাপনের পর থেকে বেশ কয়েকটি সংগঠন প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি ও মানববন্ধন করে অপসারণে দাবি জানায়; অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনেরও হুমকি দেয়।
    গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন একদল ওলামা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে আদালত প্রাঙ্গণের স্থাপিত মূর্তি দ্রæত সরিয়ে ফেলার দাবি জানলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন বলে তাদের আশ্বস্ত করেন। এরপর গত ২৫ এপ্রিল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এখানে যখন ভাস্কর্য বসানো হয়, তখন সেটা আমাদের জানানো হয়নি; সরানো হবে কিনা, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতিই নেবেন।
    এর আগে গত ৯ এপ্রিল মূর্তি অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করে আরিফুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। রিটে এটা অপসারণে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে। রিটে ধর্ম সচিব, আইন সচিব, গণপূর্ত সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও দুই রেজিস্ট্রার, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী এবং আইনজীবী সমিতির সম্পাদককে বিবাদী করা হয়। আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের সামনে ‘মূর্তি’ স্থাপন সংবিধানের ১২ ও ২৩ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
    হেফাজতের বিবৃতি: পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই অপসারণের দাবি জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী। অন্যথায় তাঁরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন হুমকি। গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক যুক্ত বিবৃতিতে তাঁরা এই দাবি জানান। প্রধান বিচারপতির কাছে দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়,তৌহিদি জনতার চাওয়াকে গুরুত্ব দিন এবং এই ইস্যুতে দেশে  যেন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য মূর্তি অপসারণে দ্রæত পদক্ষেপ নিন। এদিকে কাল (রোববার) প্রধান মন্ত্রী বরবার মূর্তি অপসারণের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করবে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। এছাড়াও আগামী ২৫ মে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রধান করবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

    আয়ারল্যান্ডকে উড়িয়ে ৮ উইকেটে জিতল টাইগাররা

    ত্রিদেশীয় সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডকে ৮ উইকেটে হারিয়েছে টাইগাররা। ১৮২ রানের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে মাত্র ২৭.১ ওভারে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে সৌম্য সরকার ৬৮ বলে ৮৭ রানে অপরাজিত থাকেন।
    এর আগে উড়ন্ত সূচনা করে বাংলাদেশের দুই টাইগার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। ১৩ ওভারে ৫ বলে দলীয় ৯৫ রানে আউট হন তামিম ইকবাল (৪৭)।  এর পর সাব্বির রহমানের সঙ্গে জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে এগিয়ে যান সৌম্য সরকার। সাব্বির রহমান ৩৪ বলে ৩৫ রান করে আউট হন।
    এর আগে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারের আগেই অলআউট হয় আইরিশ ব্যাটসম্যানরা। বাংলাদেশি বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ৪৬.৩ ওভারে ১৮১ রানেই গুটিয়ে যায় আয়ারল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ।
    আইরিশ ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে কাটার মাস্টার খ্যাত মুস্তাফিজ। ত্রিদেশীয় সিরিজে দারুণ ফর্মে আছেন মুস্তাফিজন। তবে আজকের ম্যাচেই তাকে সবচেয়ে ভয়ংকর রুপে দেখা গিয়েছে। মুস্তাফিজের কাটার, স্লোয়ার ও বাউন্সারের যেন কোন জবাব জানা ছিলনা আইরিশ ব্যাটসম্যানদের কাছে। বাংলাদেশের তৃতীয় ম্যাচে নিজের প্রথম ওভারেই তুলে মুস্তাফিজ নেন স্টারলিংয়ের উইকেট। দ্বিতীয় স্পেলেও তিনি ফেরান আয়ারল্যান্ডের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান নিয়াল ও’ব্রায়েনকে (৩০)। থার্ড ম্যানে তামিম ইকবালের সহজ ক্যাচ হন আইরিশ ব্যাটসম্যান।পরের বলে কেভিন ও’ব্রায়েনের উইকেটটি পেতে পারতেন মোস্তাফিজ। কয়েক ইঞ্চির জন্যে সাব্বির রহমান ক্যাচটি লুফে নিতে পারেননি। বাংলাদেশ আউটের আবেদন করলে টিভি রিপ্লেতে দেখা গেছে বল মাটিতে লেগে সাব্বিরের হাতে গেছে।  তবে শেষ পর্যন্ত ৩১.৪ ওভারে আর ব্যর্থ হননি।  কেভিনকে তালুবন্দি করেন মোসাদ্দেক হোসেন। কেভিন বিদায় নেন ১০ রানে।এক ওভার বিরতি দিয়ে ফের উইকেট নেন মোস্তাফিজুর। ৯ ওভারে ২ মেডেন দিয়ে ২৩ রানে ৪ উইকেট তুলে নিয়েছেন মুস্তাফিজ ।
    এর আগে অভিষেক ওয়ানডেতে প্রথম ওভারেই উইকেট তুলে নেন সানজামুল। এড জয়েসকে হাফসেঞ্চুরি বঞ্চিত করেছেন এ স্পিনার। ব্যক্তিগত ৪৬ রানে লং অনে তামিম ইকবালকে ক্যাচ দেন আয়ারল্যান্ডের এ ব্যাটসম্যান। সানজামুল ৫ ওভারে ২২ রান দিয়ে ২ উইকেট লাভ করেন।
    এই সিরিজে বাকিরা সাফল্য পেলেও নিষ্প্রভ ছিলেন সাকিব। কিন্ত এই ম্যাচ দিয়ে ফিরে পেয়েছেন নিজেকে।  ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রথম উইকেট পান সাকিব আল হাসান। নিজের দ্বিতীয় ওভারে অ্যান্ডি ব্যালবার্নিকে (১২) বোল্ড করেন তিনি। মোসাদ্দেক হোসেন তার আগে নেন আয়ারল্যান্ডের দ্বিতীয় উইকেট। আগের ওভারেই উইলিয়াম পোর্টারফিল্ডকে শর্ট এক্সট্রা কভারে জীবন দিয়েছিলেন মোসাদ্দেক। সহজ ক্যাচ ছেড়ে দিয়ে মাশরাফি মুর্তজাকে উইকেটবঞ্চিত করার পর নিজেই সেই আক্ষেপ কাটান তিনি। ক্রিজে শক্তিশালী হয়ে ওঠা আয়ারল্যান্ড অধিনায়ককে ফিরতি ক্যাচ বানিয়েছেন মোসাদ্দেক। ২৫ বলে ৩ চার ও ১ ছয়ে ২২ রানে আউট হন পোর্টারফিল্ড।
    শুক্রবার টস জিতে ফিল্ডিং নিয়ে শুরু থেকে দারুণ খেলছে বাংলাদেশ।স্বাগতিক আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওভারে রুবেল হোসেন করেন মেডেন। আর পরের ওভারে মোস্তাফিজের বলে উইকেট হারায় আয়ারল্যান্ড। তাদের কোনও রান না দিয়ে উইকেট তুলে নেন বাঁহাতি পেসার।
    আয়ারল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটিতে ক্রিজে নেমেছিলেন পল স্টারলিং ও এড জয়েস। রুবেলের গতির কাছে সতর্ক হয়ে ৬ বল পার করেন জয়েস।
    ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে বৃষ্টির কারণে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। মালাহিডে টস হেরে প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে ৩১ দশমিক ১ ওভারে ৪ উইকেটে ১৫৭ রান তুলে টাইগাররা। এরপর বৃষ্টির কারণে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ফলে ২টি করে পয়েন্ট পায় দু’দল।

    সমগ্র বিশ্বে একই দিনে চান্দ্রমাসের সূচনা : একই দিনে রোযা ও ঈদ

    প্রথমত : ভৌগোলিক ও জ্যোতির্শাস্ত্রীয় বাস্তবতার আলোকে

    সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু করা, রমযান মাস শেষ হলে একই দিনে ঈদ করা এবং একই দিনে ঈদুল আযহা করাÑ ভৌগোলিক ও জ্যোতির্শাস্ত্রীয় বাস্তবতার দিক থেকে এগুলো মূলত সম্ভবই নয়। কার্যত যা সম্ভব নয়, শরীয়ত নাযিলের সময় সে বিষয়ের ধারণা থাকলেও, শরীয়ত এর হুকুম দেয় না। আর একে তো অসম্ভব, আবার সে সময় এর ধারণাও ছিল না, এমন বিষয়ের হুকুম শরীয়ত কীভাবে দেবে?

    কথা এমনিতেই খুব পরিষ্কার; তা সত্ত্বেও আরো স্পষ্ট করার জন্য প্রথমে আমরা বাস্তবতার আলোকে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখব তারপর শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এর আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

     

    সম্ভাব্যতা যাচাই

    রোযা ও ঈদের ঐক্যের ডাক বেশি আগের নয়, আবার বেশি নতুনও নয়, ষাট বছরেরও কিছু বেশি এর বয়স। প্রথমে যারা এই আওয়াজ তুলেছেন তারা শুধু মুসলিম বিশ্বব্যাপী ঐক্যের প্রস্তাব পেশ করেছেন। পরবর্তীরা বিশ্বব্যাপী এক করার জন্য পীড়াপীড়ি করছেন এবং এখনও করে চলেছেন।

    আমরা উভয় দাবির সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চাই। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করুন :

    এক. আমাদের কি বিশ্বব্যাপী কোনো সর্বজনীন নেতৃত্ব আছে?

    একই দিনে বিশ্বব্যাপী রোযা ও ঈদ করা, অন্তত সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা, এক্ষেত্রে জানা কথা যে, আমাদের সম্মিলিত কোনো খেলাফত বা নেতৃত্ব অথবা সম্মিলিত কোনো রাষ্ট্র কিছুই নেই। বিশ্বব্যাপী তো নেইই; মুসলিম বিশ্বব্যাপীও নেই। অথচ হিলালের বিশ্বব্যাপী সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য কোনো না কোনো বিশ্বব্যাপী শক্তি ও নেতৃত্বের প্রয়োজন, যেই নেতৃত্ব সবাই মেনে নেবে। এমন কিছু তো বিলকুল নেই! ওআইসি, এটা তো কোনো বিশ্বজনীন সংস্থা নয়। এর নামই তো হল ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন’। আর ওআইসির ফিকহ একাডেমীর সিদ্ধান্তও ওআইসি সমর্থিত হওয়া জরুরি নয়। তাই ফিকহ একাডেমীর সিদ্ধান্ত ওআইসির কাছে কোনো আইনী মর্যাদা রাখে না। ফিকহ একাডেমী ১৯৮৬ ঈ. সনে এই সুপারিশ পাশ করে যে, কোনো এক শহরে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে সকল মুসলমানের উপরই ঐ চাঁদ দেখা মোতাবেক আমল ওয়াজিব হয়ে যাবে। এই সুপারিশের পর এখন ২০১৬ ঈ. শেষ হয়ে গেল। মোট ত্রিশ বছর পার হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত সেই সুপারিশের উপর আমলের কী পদ্ধতি হবে সে বিষয়ের কোনো খসড়াও তারা পেশ করতে পারেনি এবং ওআইসির মন্ত্রীসভাও একে কার্যকর করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেয়নি।

    এই প্রস্তাব অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বে বা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা, একে বাস্তবায়ন করার জন্য অন্তত চাঁদ দেখার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত বিশ্বজনীন সংগঠনের প্রয়োজন, যার প্রতি সবার ঐকমত্য থাকবে। এর সিদ্ধান্তের প্রতি সমস্ত মুসলমানের আস্থা থাকবে। অন্তত চাঁদ দেখার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই সংগঠনের ফায়সালা অবশ্য-গ্রহণীয় বলে বিবেচিত হবে। আজও পর্যন্ত কি এরকম কোনো সম্মিলিত সংগঠন অস্তিত্বে এসেছে?

    ডক্টর এ কে এম মাহবুবুর রহমান, ডক্টর আব্দুল্লাহ মারূফ প্রমুখের গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত পুস্তিকা ‘পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীয়াহ কী বলে? এর শেষ কথায় তারা যা লিখেছেন, তা হলÑ

    আসুন আমরা হকের পক্ষে কথা বলি :

    ‘আলেম সমাজ ও আম জনতাকে আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন আমরা সকল অসত্যের জাল ছিন্ন করে বেড়িয়ে আসি, সঠিক দ্বীনি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসকল সমস্যার সমাধান করি। আজকের মুসলমানদের ফরয দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের তৈরি সীমানা উপড়ে ফেলে মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার[1], যারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ইসলাম বাস্তবায়ন করবে এবং ইসলাম অনুযায়ী সমাধান প্রদান করবে, সকল মুসলমানকে একই তারিখে রোযা রাখা এবং ঈদ উদযাপন করার ঘোষণা প্রদান করবে এবং সকল উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করবে। মূলতঃ একমাত্র ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রের পক্ষেই তা সম্ভব। আমীন। (পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীয়াহ কী বলে?, পৃ. ৪৮)

    এই কথাটাই হল আসল কথা, রোযা ও ঈদের ক্ষেত্রে ঐক্যের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য প্রথমে এটাই করা উচিত। এটা না হোক অন্তত এটুকু তো অবশ্যই হওয়া উচিত, যা উপরে বলা হয়েছেÑ অন্ততঃ চাঁদ দেখার প্রসঙ্গে সর্বমান্য, সর্বসম্মত, বিশ্বজনীন  গ্রহণযোগ্য চাঁদের সিদ্ধান্ত দানকারী কোনো সংগঠন হওয়া উচিত। কিন্তু কোথায় সেরকম সংগঠন? তাছাড়া যদি এমন কোনো সম্মিলিত সংগঠন অস্তিত্বে এসেও যায় তারপরেও কার্যত একই দিনে বা একই তারিখে সমগ্র বিশ্বে তো দূরের কথা গোটা ইসলামী বিশ্বেও সময়ের ব্যবধানের কারণে ঐক্য সম্ভব হবে না।

     

    দুই. ঐক্যের ভিত্তি কী হবে?

    দ্বিতীয় কথা হল, চান্দ্রমাসের সূচনার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী আমরা যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি, সেই ঐক্য কীসের ভিত্তিতে হবে? শরয়ী পদ্ধতিতে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে, না জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে? দুই পদ্ধতির যে পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক বাস্তব  ক্ষেত্রে ঐক্য অসম্ভব।

    (ক)

    শরয়ী পদ্ধতিতে চাঁদ দেখার বিধান ছেড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের পদ্ধতি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে প্রথম কথা তো হল, কোনো রাষ্ট্রেই আহলে হক উলামা এবং তাদের অনুসারীগণ এই পদ্ধতির সাথে একমত হবেন না এবং একমত হতে পারেন না! সেক্ষেত্রে ঐক্যের চিন্তা করাটাই ভুল। তারপরও কথার কথা, কেউ যদি জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান তাহলে কি তিনি চাঁদের সম্মিলন বা সংযোগ (কনজাঙ্কশান) এর হিসাব গ্রহণ করবেন নাকি চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার পদ্ধতি গ্রহণ করবেন? যদি চাঁদের কনজাঙ্কশানের হিসাব গ্রহণ করতে চান, তাহলে কনজাঙ্কশান তো দিন-রাতের যে কোনোও সময়ে, যে কোনো জায়গায় হতে পারে। এখন ধরুন, কনজাঙ্কশানের সময় কোনো এলাকায় সাহরীর সময় চলছে, তারা তো রোযা রাখতে পারবে, ঠিক আছে, কিন্তু যেসব এলাকায় ঐ সময় ফজরের নামায হয়ে গিয়েছে /সূর্য ঢলে পড়েছে সেখানকার অধিবাসীরা কি সেদিন রোযা রাখবে, না পরের দিন? যদি সেদিনই রোযা রাখে তবে তো সেটা অযৌক্তিক; বাস্তবতার নিরিখেও এবং শরীয়তের বিধান হিসেবেও। আর যদি পরের দিন রাখে তবে আর ঐক্য হল কোথায়?

    (খ)

    যদি চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার হিসাব গ্রহণ করা হয়, তাহলেও প্রথম কথা হল, চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার ভিত্তি খোদ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছেই ভিন্ন ভিন্ন। এ জন্যই চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার নীতি অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত লুনার ক্যালেন্ডারে পরস্পর অনেক বৈপরিত্য ও ভিন্নতা পাওয়া যায়। সুতরাং চাঁদ দেখার সম্ভাব্য সময়ই যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন সেহেতু এর ভিত্তিতে ঐক্য কীভাবে হবে? এত লুনার ক্যালেন্ডার দিয়ে রোযা ও ঈদ একসাথে কীভাবে করা যাবে?

    আরেকটি কথা চিন্তা করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে জুমার নামাযই IDL (ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন)-এর এ পাশে আর ও পাশে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে হচ্ছে! তাহলে এরপরও ঈদ কি একই দিনে হয়?!

    (গ)

    এখন বাকি থাকল শরয়ী ভিত্তি ‘হিলাল দেখা’। আর এটাই একমাত্র সঠিক ব্যবস্থা, যার ভিত্তিতে ইসলামী মাসসমূহের শরয়ী সূচনা হবে, রোযা শুরু হবে, ঈদ হবে…। হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করলে অন্তত একদিনের ব্যবধান অবশ্যই হবে। হিলাল দেখার ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু করা, একই দিনে ঈদ করা বাস্তব ক্ষেত্রে সম্ভবই নয়। প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ অঞ্চলের হিলাল দেখে আমল করে তাহলে ঐক্য সম্ভব না হওয়া তো খুবই স্পষ্ট! সাড়ে চৌদ্দশ বছরের এটাই বাস্তবতা! আর যদি কোনো এক অঞ্চলের হিলাল দেখাকে ভিত্তি বানানো হয়, তবে সেটা কোন অঞ্চল? শরীয়তের কোন্ দলীলের মাধ্যমে সেটা নির্ধারিত হবে? কীসের ভিত্তিতে সেটা অগ্রাধিকার পাবে?

    (ঘ)

    কেউ যদি কোনো দলীল ছাড়াই শুধু আবেগের বশে সৌদিআরব অথবা মধ্য প্রাচ্যের কোনো অঞ্চলের হিলাল দেখাকে ভিত্তি বানায় তাহলে বিষয়টি বোঝার জন্য নিম্নোক্ত উদাহরণ লক্ষ্য করুন, যা ডক্টর মাহবুবুর রহমান তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি  লেখেনÑ

    ‘প্রতি চান্দ্র মাসের নতুন চাঁদ সকল সময়ই মধ্য প্রাচ্যের কোনো দেশে সর্ব প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। তাই মধ্য প্রাচ্যের স্থানীয় সময়ের সবচেয়ে দূরতম অগ্রগামী সময়ের দেশ হচ্ছে জাপান। তার সাথে সময়ের পার্থক্য ৭-৩০ ঘণ্টা। ধরা যাক যদি, মধ্য প্রাচ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় নতুন চাঁদ দেখে। ঐ সময় পৃথিবীর সর্বপূর্ব স্থান জাপানে রাত ১টা ৩০ মিনিট। তখন জাপানে সাহরী খাওয়ার সর্বনি¤œ সময় হলো ৩টা ৪৩ মিনিট। তাহলে জাপানবাসী চাঁদ উদয়ের সংবাদ পাওয়ার পরেও রোযা রাখতে সাহরী খাওয়ার জন্য সময় পাচ্ছেন। উপরন্ত ঐ সময়ের মধ্যে তারাবীর নামায আদায় করাও সম্ভব এবং শুক্রবার রোযা পালন করা সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বে অবস্থিত অন্যান্য দেশের সাথে সময়ের পার্থক্য আরো কম ফলে তারা রোযা রাখার জন্য আরো বেশি সময় পাবেন।’ (পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীআহ কী বলে?, পৃ. ৩৯-৪০)

    তিনি এটা খেয়াল করেননি যে, এরা তো রাত দেড়টায় গভীর ঘুমে থাকবে। সে সময় চাঁদের খবর তারা কীভাবে পাবে। আর এখানে যা সময় বলা হয়েছে, তা হল জাপানের একটি শহরের হিসেবে। আরো পূর্বের শহরগুলোতে রাতের আরো কম সময় বাকি থাকবে। তাছাড়া উদাহরণটি একটি ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে পেশ করা হয়েছে। তা হল, ‘প্রতি চান্দ্র মাসের নতুন চাঁদ সকল সময়ই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে সর্ব প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়।’ অথচ এটা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্য এবং বাস্তবতার পরিপন্থী। নতুন চাঁদ সাধারণত পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তেই দৃষ্টিগোচর হয়। এমনকি তা কোনো কোনো মাসে প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর থেকে সর্বপ্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। তাছাড়া পশ্চিম প্রান্তের সাথে জাপান নয় ইন্দোনেশিয়ার সময় ধরুন। মৌরতানিয়ায় যখন হিলাল দেখা যাবে তখন ইন্দোনেশিয়ায় দিনের কোন সময়? একটু চিন্তা করুন!

    ডক্টর মাহবুবুর রহমান সামনে আরো লিখেছেন-

    ‘এবার পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশ নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১০৫ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমার দেশসমূহ মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্রের আলবুক্য়ার্ক, ডেনভার, সিয়েন, মাইলস্ সিটিতে চাঁদ দেখার সংবাদ পৌঁছবে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টায়। এমনিভাবে সর্বশেষ ১৮০ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে চাঁদ দেখার সংবাদ পৌঁছবে সেখানের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ভোর ৪ টায়। অতএব মধ্যপ্রাচ্য বৃহস্পতিবার চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে তারা শুক্রবার ১ রমযানের রোযা পালন করবে। অর্থাৎ সারা পৃথিবীব্যাপি একই দিন রোযা পালন করা সম্ভব।’ (পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীআহ কী বলে?, পৃ. ৪০)

    এটা তিনি আজব কথা লিখেছেন, কারণ কথা যদি এটাই হয় যে, সমগ্র বিশ্বে একই হিলালের উপর আমল করতে হবে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যে হিলাল দেখা যাবে, সেই হিলালের উপর তো হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ-বাসীদের তৎক্ষণাৎ আমল করা উচিত। তাদের তো বৃহস্পতিবার থেকেই রোযা রাখা উচিত। সৌদি আরব অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে হিলাল দেখার পর যে এলাকায় সাহরীর সময় পাওয়া যাবে, অন্তত রোযার নিয়ত করার সময় পাওয়া যাবে তাদের তো জুমার দিন পর্যন্ত রোযা বিলম্ব করার পরামর্শ দেওয়া ভুল। আপনি যেহেতু সমগ্র বিশ্বে একই হিলালের উপর আমল করার কথা বলেন, তো আপনি কীভাবে তাদেরকে এই পরামর্শ দিতে পারেন? তো তারা যদি বৃহস্পতিবার রোযা রাখে তাহলে তারা মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের চেয়ে একদিন আগে রোযা রাখল। আর যদি শুক্রবার রাখে তাহলে তো এরা বৃহস্পতিবার (দিবাগত) সন্ধ্যায় নিজেরাই হিলাল দেখবে। তাদের রোযা তাদের হিলাল দেখা মোতাবেকই হবে। মধ্যপ্রাচ্যের হিলাল দেখা মোতাবেক নয়। বৃহস্পতিবারের হিলালই তাদের জন্য হিলাল। যদিও আপনারা জবরদস্তি করে এটাকে পুরোনো চাঁদ বলতে চান। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় চাঁদ এখনও পর্যন্ত উদিত হয়ইনি।

    এই সকল সম্মানিত ব্যক্তি যদি এই উদাহরণ নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করেন, তাহলে তারা ইসলামী চান্দ্রমাসের ক্ষেত্রে একের অধিক হিলালের বিষয়টিও বুঝতে পারবেন। তাহলে জ্যোতির্বিজ্ঞান; যার দোহাই দিয়ে এত লড়াই-ঝগড়া, উলামায়ে কেরামকে এত জাহেল বলা, সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানও তো একের অধিক হিলালের ধারণাই দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানও তো উদয়স্থলের ভিন্নতাকে মেনে নিচ্ছে। এরকম প্রত্যক্ষ ও বাস্তব বিষয়কে জ্যোতির্বিজ্ঞান কখনোই অস্বীকার করে না।

    যাই হোক, এখন আমরা যা বলতে চাচ্ছি তা হল, মধ্যপ্রাচ্যের হিলালকে যদি প্রথম এবং একমাত্র হিলাল ধরা হয় এরপর একে সমগ্র বিশ্বে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে বাস্তব ময়দানে কত জটিলতা সামনে আসবে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

    চিন্তা করুন, যে সন্ধ্যায় হিলাল দেখা যায়, রোযা এর পরের দিন হয়। এ ক্ষেত্রে হাওয়াইবাসীরা তো ‘বিশ্বব্যাপী প্রথম হেলাল দিয়ে রোযা রাখা’র নীতি অনুযায়ী বৃহস্পতিবারে রোযা রাখবে, তারা তো হিলালের আগের দিন রোযা রাখছে! আপনার কাছে এর কী ব্যাখ্যা?

    আরো শুনুন, এরা যখন বৃহস্পতিবারে রোযা রাখল তখন তো শুক্রবার রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) তাদের জন্য দ্বিতীয় তারিখ। কারণ ইসলামী চান্দ্র ক্যালেন্ডারে দিন ও তারিখ সূর্যাস্তের পর থেকেই শুরু হয়ে যায়। এখন যাদের নতুন চাঁদ দেখে হাওয়াইবাসীরা বৃহস্পতিবার রোযা রেখেছে অর্থাৎ (মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের চাঁদ) তারা তো রোযা রাখবে শুক্রবারে, যা হাওয়াইবাসীদের জন্য অবশ্যই অবশ্যই দ্বিতীয় তারিখ। এটাকে যদি হাওয়াইবাসীদের জন্য প্রথম তারিখ বলা হয়, তবে কি তারা শা‘বানে রোযা রেখেছে? যেহেতু এটা মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম তারিখ আর হাওয়াইয়ে দ্বিতীয় তারিখ আর হাওয়াইবাসীদের রোযা হয়েছে বৃহস্পতিবার, মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের রোযা হয়েছে শুক্রবার তবে তো এখানে দিন তারিখ সবই ভিন্ন ভিন্ন হল! আর এটাও কত অবাক কা- যে, যাদের হিলাল দেখে রোযা রাখা হচ্ছে, তারা রোযা রাখছে পরে, আর অন্যরা রোযা রাখছে আগে।

    এটা অবশ্য ভিন্ন এক বিষয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন হিলাল উঠার সম্ভাব্য সন্ধ্যা যখন, তখন তো হাওয়াইবাসীরা রাত যাপন করছে। তো বেচারাদেরকে শেষ রাতে ঘুমের অবস্থায় চাঁদ দেখার সংবাদ/সাক্ষ্য কীভাবে পৌঁছানো হবে?

    আপনি যদি বলেন, হাওয়াইবাসীরা মধ্যপ্রাচ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৃষ্টিগোচর হওয়া হিলালের ভিত্তিতে (যার সংবাদ তারা বৃহস্পতিবার সুবহে সাদিকের কিছু আগে বা সুবহে সাদিকের পর পেয়েছে) শুক্রবার রোযা রাখবে। তাহলে প্রথম প্রশ্ন হলÑ আপনাদের কথা মত যদি সর্বপ্রথম হিলাল দেখার মাধ্যমেই সমগ্র বিশ্বে হিলাল উদিত হয়ে রমযান শুরু হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তারা পূর্ণ একদিন রোযা ছাড়া কীভাবে কাটাবে? আপনারা যেভাবে কাফফারার ভয় দেখান, তাদের উপর এক রোযার পরিবর্তে ষাট রোযার কাফফারা আসবে না তো?!

    (ঙ)

    এ কথা আগেও বলা হয়েছে যে, এই ধারণা ভুল যে, নতুন চাঁদ প্রথমে মক্কায়, অথবা সৌদি রাষ্ট্রের সীমানায় অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাষ্ট্রে দেখা যায়। আমরা বেশ কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাছে এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তারা বলেছেন, নতুন চাঁদ সর্বপ্রথম দেখা যাবে এমন নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। এটাও নির্দিষ্ট নেই যে, প্রতি মাসে নতুন চাঁদ একই জায়গায় প্রথমবার দেখা যাবে। বরং কখনো এক জায়গায় দেখা যায়, কখনো অন্য জায়গায়। তবে অধিকাংশ সময় পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তেই সর্বপ্রথম নতুন চাঁদ দৃষ্টিগোচর হয়। তাদের পত্রগুলো আমাদের কাছে আছে। এ বিষয়ের কিতাবে ইনশাআল্লাহ সেগুলো প্রকাশ করা হবে।

    এই বিষয়টি জানার জন্য ইন্টারনেটে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া মুন সাইটিংয়ের চান্দ্রগোলকের বিভিন্ন ছবি দেখা যেতে পারে। সেখানে দেখবেন যে, বছরের অনেক মাসে বরং কোনো কোনো বছরের অধিকাংশ মাসে প্রথম দর্শনযোগ্য চাঁদের ‘দৃষ্ট-রেখা’র বৃত্তে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ নেই। বৃত্তের ভেতরে আছে কখনো প্রশান্ত মহাসাগর বা আটলান্টিক মহাসাগর, কখনো হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, কখনো পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তের অন্যান্য দেশ।

    যেহেতু এটাই বাস্তবতা যে, সবসময় হিলাল প্রথমবার সৌদিআরব বা মধ্যপ্রাচ্যে দৃষ্টিগোচর হয় না; বরং অধিকাংশ সময় পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে দৃষ্টিগোচর হয় সুতরাং বাস্তব ক্ষেত্রে রোযা ও ঈদের ঐক্য সম্ভব কি না তা যাচাই করার জন্য পশ্চিম প্রান্তের এলাকাগুলোর সাথে পূর্ব প্রান্তের এলাকাগুলোর সময় মিলিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত উদাহরণটি লক্ষ্য করুনÑ

    ধরে নিন, ৫ই জুন সন্ধ্যা ২৯ শা‘বানের সন্ধ্যা। কিন্তু প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের কোনো দেশেই চাঁদ দেখা যায়নি। আবাদি স্থানগুলোর মধ্যে শুধু হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে হিলাল দেখা গেছে সন্ধ্যা ছয়টায়। ধরে নিন যে, কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে এর সাক্ষ্য বা সংবাদ প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এসে পৌঁছল। কিন্তু বিষয় হল, হাওয়াইতে ৫ই জুন সন্ধ্যায় হিলাল দেখা গেছে, তখন বাংলাদেশে ৬ই জুন সকাল দশটা এবং মালয়েশিয়ায় সকাল আটটা। এখন এখানকার লোকেরা যে রোযা রাখবে কীভাবে রাখবে? আর যদি না রাখে তাহলে সাতই জুন হবে তাদের প্রথম রোযা অথচ সেদিন হাওয়াই-র অধিবাসীদের ২য় রোযা চলছে। তাহলে একই দিনে সবার রোযা হল কোথায়? কীভাবেই বা হতে পারে? আর যদি বলেন, হোক না হোক, প্রাচ্যের অধিবাসীদের ৬ই জুনই রোযা রাখতে হবে, তাহলে তারাবীহ ছাড়া, সাহরী ছাড়া, রাতে নিয়ত করা ছাড়া কোন্ দলীলের ভিত্তিতে এদের উপর রোযা ফরয করে দেওয়া হবে?[2] এর চেয়ে বড় কথা হল, রোযার নির্ধারিত সময় তো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। অথচ এক্ষেত্রে প্রাচ্যের বাসিন্দাদের দিনের বিভিন্ন সময়ে রোযা শুরু করতে হচ্ছে?!

    এর চেয়েও বড় কথা হল, হিলাল দেখার আগে তো রোযার সময় শুরুই হয় না; প্রাচ্যের বাসিন্দাদের কাছে যদি দিনের কোনো অংশে হাওয়াইয়ের হিলাল দেখা প্রমাণিত হয়ে যায়, আর ততক্ষণ পর্যন্ত এরা কিছু না খেয়েও থাকে তাহলেও তো তাদের রোযা সুবহে সাদিক থেকে হয়েছে গণ্য হবে না। কারণ তাদের সুবহে সাদিকের সময় দুনিয়ার কোথাও নতুন চাঁদ দেখাই যায়নি। এ জন্য ঐটা রোযার সময় ছিল না।

    আর যদি মেনেও নেওয়া হয় যে, প্রাচ্যের বাসিন্দারা ৬ই জুনই রোযা রাখবে তাহলে প্রশ্ন হল, পরবর্তীতে যদি হাওয়াইয়ের বাসিন্দারা তাদের হিসাব মতো ২৯ শাবান সন্ধ্যায় হিলাল না দেখে তাহলে তো তাদের পূর্ণ ত্রিশ দিন রোযা রাখতে হবে। তখন প্রাচ্যের বাসিন্দাদের মোট রোযা হয়ে যাচ্ছে একত্রিশটি!

    দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, প্রাচ্যের বাসিন্দাদের এই অসম্পূর্ণ রোযা রমযানের ফরয রোযা হিসাবেই ধর্তব্য হবে নাকি এর কাযা আদায় করা তাদের জন্য আবশ্যক? যদি কাযা করতে হয়, তাহলে ঐক্যের আর অর্থ কী? আর যদি কাযা না করতে হয় তাহলে অসম্পূর্ণ রোযা দিয়ে ফরয কীভাবে আদায় হবে?

    আজ ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৬ ঈ. জুমাবার দিবাগত রাত এখানে সন্ধ্যা সাতটা বিশ মিনিটে কানাডার রিরহরঢ়বম শহরে অবস্থানরত এক বন্ধুর কাছে কিছু তথ্যের বিষয়ে ফোন করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘আমাদের এখানে আজকে জুমাবার সকাল সাতটা বিশ মিনিট’। অর্থাৎ পূর্ণ বার ঘণ্টার ব্যবধান। আর আমাদের তো শনিবার শুরু হয়ে গেছে, অথচ তারা এখনও জুমার নামাযই পড়েননি। ধরে নিন কানাডাতে যদি হিলাল প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়, যেদিন সন্ধ্যায় সেখানে হিলাল দেখা যাবে, সেসময় আমাদের এখানে হবে পরের দিন সকাল। আমরা যদি ঐ দিনই রোযা রাখি, তবে সে রোযা হবে অসম্পূর্ণ, আর যদি পরের দিন রোযা রাখি, তাহলে দিন ও তারিখ ভিন্ন হয়ে যাবে।

    এমনিভাবে প্রথম হিলাল যদি আলাস্কায় হয় তাহলে তো কোরিয়ার মুসলমানেরা যখন এর সংবাদ পাবে তখন তারা সকাল ৯/১০টা পার করছে। তাদের জন্য তো নিয়মমত রোযা রাখা সম্ভবই নয়। আবার এই হিলালের সংবাদ নিউজিল্যান্ডে এমন সময় পৌঁছবে যখন তাদের দিন-তারিখ সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। কারণ হল, এক দেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইনের’ এক পাশে আরেক দেশ অপর পাশে। নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা যদি আলাস্কার অধিবাসীদের সাথে একই ভোরে রোযা শুরু করে তাহলেও তাদের দিন ও তারিখ ভিন্ন হবে।

    মোটকথা, প্রথমত বিশ্বজনীন কোনো নেতৃত্ব নেই। দ্বিতীয়ত সময়ের ব্যবধান অনেক। এসব কারণে বাস্তবতার আলোকে একই দিনে রোযা শুরু করা, একই দিনে ঈদ করা না বিশ্বব্যাপী সম্ভব না মুসলিম বিশ্বে সম্ভব।

    এবার আমরা দেখব যে, শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এর অবস্থান কী? এ ধরনের প্রয়াস-প্রচেষ্টা কি শরীয়তে কোনো জরুরি বিষয়? বা অন্তত মুস্তাহাব পর্যায়ের কোনো সওয়াবের কাজ?

     

    শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে

    বিশ্বব্যাপী একই দিনে বা একই তারিখে রোযা ও ঈদ করাকে ফরয/জরুরি সাব্যস্ত করার শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সামনে রাখতে হবে :

    ১. যে বিষয় গোড়া থেকেই সম্ভব নয় বা যে বিষয় পালনে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়, শরীয়ত কখনো এমন বিষয়ের আদেশ করে না। এজন্য যে কোনো সমঝদার ব্যক্তির কাছে প্রথম ধাপেই এই ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা শরীয়তের নির্দেশ হতেই পারে না। অসম্ভব অথবা প্রায় অসম্ভব কোনো কাজের আদেশ শরীয়ত করতে পারে না।

    ২. শরীয়ত নাযিলের সময় যে বিষয়ের কোনোও ধারণা-কল্পনাও ছিল না, এরকম বিষয় শরীয়তের নির্দেশ হওয়ার কথা ভাবাই যায় না। সুতরাং এখানে তো একথা পরিষ্কার যে, এই কাজ শরীয়তের নির্দেশ হতে পারে না।

    ৩. নব উদ্ভাবিত কোনো কাজকে ফরয-ওয়াজিব তো দূরের কথা; সুন্নতের মর্তবাও যদি দেওয়া হয় তাহলেও এটা বিদআত হয়ে যায়। আর বিদআত তো গোমরাহী আর ভ্রষ্টতা।

    ৪. যে কাজের বিশেষ কোনো সওয়াব বা ফযীলত কুরআন হাদীসে বর্ণিত হয়নি আবার এই কাজ করতে গেলে অনেক কষ্ট ও অসুবিধা দেখা দেয় এরকম কাজ তো নিঃসন্দেহে ‘তাকাল্লুফ’ তথা লৌকিকতা ও নিরর্থক আয়োজন ছাড়া কিছু নয়। আর এ উম্মতকে এসব তাকাল্লুফ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছেÑ نهينا عن التكلف  আমাদেরকে তাকাল্লুফ থেকে নিষেধ করা হয়েছে।

    ৫. বিশ্বব্যাপী এই ঐক্যের শরয়ী কোনো মানদ- নেই। এটা যদি শরীয়তে নির্দেশিত হতই তাহলে শরীয়তে এর কোনো মানদ-ও থাকত। এই প্রসঙ্গে যে তিনটি মানদ- বলা হয়, এর একটাও আমলযোগ্য নয়!

     

    ক. জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত লুনার ক্যালেন্ডার

    এতে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন হয়ে যায়। সুতরাং এটা সম্পূর্ণ না-জায়েয। শরীয়ত-নির্ধারিত ভিত্তি ‘হিলাল দেখা’ পরিবর্তন করার ইখতিয়ার কারো নেই। কেউ যদি পরিবর্তন করে দেয়ও তাহলেও আহলে হক মুসলমানরা একে গ্রহণ করবে না। তাহলে ঐক্য কীভাবে হবে।

     

    খ. প্রথম হিলাল দেখা

    এটা এ জন্য মানদ- হতে পারে না যে, প্রথমবার কোথায় হিলাল দৃষ্টিগোচর হয়, তা অনুসন্ধান করার হুকুম শরীয়ত দেয়নি। আর বাস্তবে দূর-দূরান্তের অঞ্চলের জন্য প্রথম হিলাল কোথায় কখন দেখা গিয়েছে তা অনুসন্ধান করা অনেক জটিল বিষয়। তারপরও যদি হিলাল সাব্যস্ত হয়েও যায়, তাহলেও সেটাকে বিশ্বব্যাপী কার্যকর করতে গেলে অনেক জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এজন্য এই পদ্ধতিও আমলযোগ্য নয়।

     

    গ. সৌদি আরবের হিলাল দেখাকে ভিত্তি বানানো

    সৌদিআরবের চাঁদ দেখার ভিত্তিতেও বিশ্বব্যাপী আমল করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো এক জায়গার হিলালকে সমগ্র বিশ্বের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া, শুধু এতটুকু নয় যে, তা দলীলবিহীন, বরং এটা দলীলবিরোধী। সুতরাং এই পদ্ধতিই আসলে গ্রহণ করা উচিত যে, প্রত্যেক অঞ্চলের বাসিন্দারা নিজ নিজ অঞ্চলের হিলাল দেখা অনুসারে আমল করবে।

    সুতরাং যেহেতু বিশ্বব্যাপী ঐক্যের শরয়ী কোনো মানদ- নেই তাহলে এটা শরীয়তে ফরয /ওয়াজিব বা সুন্নত তো দূরের কথা; অন্তত শরীয়তের কাম্যও হয় কীভাবে?

    ৬. শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতা হল এ-ই। কিন্তু তথাকথিত প্রগতিপন্থী কিছু লোক বিষয়টাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন এবং এর জন্য এমন এমন দলীল বের করেন, যেন কুরআন-হাদীসে সম্পূর্ণ সুস্পষ্টভাবেই বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা শুরু করা এবং একই দিনে ঈদ করার কথা বলা হয়েছে। তারা এটাও বলেন যে, ‘যেহেতু আগের যামানায় প্রচারমাধ্যম এত উন্নত ছিল না; যা এখন হয়েছে, সেজন্য আগের লোকেরা শরীয়তের ঐ ওয়াজিব বিধান বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাদের যদি সুযোগ হত তাহলে তারা অবশ্যই এটা বাস্তবায়ন করতেন।

    এখন তো প্রচারমাধ্যম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত হয়েছে যে, পুরো বিশ্ব যেন একটি গ্রাম। এখন আমাদের কুরআন-হাদীসের সেই বিধান বাস্তবায়ন করতে বাধা কোথায়?’

    সামনে আমরা সেই ভাইদের পেশকৃত দলীলের (বাস্তবে যেগুলো দলীল নয়) উপর পর্যালোচনা করতে চাই। যেন এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এরা কোনো দলীল ছাড়াই একটি নব উদ্ভাবিত বিষয়কে শরীয়তের আবশ্যকীয় বিধান সাব্যস্ত করতে লেগেছেন।

    ৭. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার অভিমত আর একই দিনে রোযা ও ঈদ জরুরি হওয়ার মতকে এক মনে করা।

    তাদের বড় এক দুর্বলতা হল, তারা ফিকহ-ফতোয়ার কিছু কিতাবে দেখেছেন যে, হানাফী মাযহাবে, (বরং এক অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে শাফেয়ী মাযহাব ছাড়া অন্য তিন মাযহাবেও এবং এক বক্তব্য অনুযায়ী শাফেয়ী মাযহাবেও) উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। সুতরাং যদি অন্য কোনো এলাকা থেকে ‘তরীকে মুজিব’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও শরয়ী নিয়ম-সমর্থিত পদ্ধতিতে খবর পাওয়া যায় তাহলে সে অনুযায়ী আমল করা জরুরি। এখান থেকে তাঁরা    এটা বুঝে নিয়েছেন যে, দেখ! সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করার কথা তো ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমও বলে গিয়েছেন!!

    এটা তাদের অসম্পূর্ণ বুঝের পরিণাম ছাড়া কিছুই নয়। প্রথম কথা তো হল, لاعبرة لاختلاف المطالع  ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ এমন ব্যাপক ও নিঃশর্ত কথা তো কোনো ইমামই বলেননি। ফিকহের কিতাবের পরবর্তী মুসান্নিফগণের অনেকে এ ধরনের নিঃশর্ত কথা যদিও লিখেছেন, কিন্তু ইমামদের কেউই এরকম নিঃশর্ত কথা বলেননি। ইমাম আহমদ ছাড়া অন্য তিন ইমামের মাযহাবেই অগ্রগণ্য বক্তব্য, যার উপর অধিকাংশ ফকীহ ফতোয়া দিয়েছেন তা এই যে, ‘কাছাকাছি অঞ্চলের ক্ষেত্রে তো এক জায়গার হিলাল দেখা অন্য জায়গার জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় হবে, কিন্তু দূরবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রে এক জায়গার হিলাল দেখা অন্য জায়গার জন্য প্রযোজ্য নয়’। হানাফী মাযহাবেরই অনেক বড় বড় ফকীহ এটা বলেছেন। ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি  থেকে এর বিপরীতে একটি শব্দও বর্ণিত হয়নি।  ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ জাতীয় বাক্য ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে পাওয়া যায়নি। আর হানাফী মাযহাবে জাহিরুর রিওয়ায়াহ মানে হল ঐসব মাসআলা, যা ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শাগরেদ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ছয় কিতাবে উল্লেখ আছে। আলহামদু লিল্লাহ ইমাম মুহাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সব কিতাব এখন ছাপা আছে। এসব কিতাবের কোথাও لاعبرة لاختلاف المطالع ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ জাতীয় কোনো বাক্য পাওয়া যায়নি।

    অবশ্য এই বাক্য কানযুদ দাকায়েকসহ ফিকহে হানাফীর কিছু কিতাবে অবশ্যই এসেছে। কিন্তু এর যে অর্থ এখন উদ্ভাবন করা হয়েছে যে, পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা ফরয, এরকম কথা সেই মুসান্নিফদের কল্পনার আশেপাশেও আসেনি। এখানে সম্পূর্ণ নব উদ্ভাবিত একটি বিষয়কে এই বাক্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য শুধু এ কথা বলা যে, নিজ অঞ্চলের বাইরে থেকেও হিলাল সাব্যস্ত হওয়ার শরয়ী সাক্ষ্য যদি ‘তরীকে মুজিব’ এর মাধ্যমে এসে যায়, তবে সে অনুযায়ী আমল করা জরুরী। কিন্তু তাদের কেউ এ কথা বলেননি যে, ২৯ শা‘বান সন্ধ্যায় মুসলমানদের দায়িত্ব শুধু এটুকু নয় যে, নিজ নিজ এলাকায় হিলাল তালাশ করবে বরং তাদের উপর এটাও ফরয যে, সারা বিশ্বের কোনো এলাকায় আজ হিলাল দেখা গিয়েছে কি না তা সন্ধান করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদ ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই করতে হবে, হিলাল দেখা প্রমাণিত হলে তা সারা বিশ্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ কথা যদি কোনো একজন ফকীহও কোথাও লিখতেন, তাহলেও বলা যেত যে, যাক! একজন ফকীহ তো অন্তত এ কথা বলেছেন! কিন্তু চার মাযহাবের ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবের বিশাল ভাণ্ডারে কোনো নির্ভরযোগ্য ফকীহের কিতাব থেকে এরকম কথা ইনশাআল্লাহ দেখানো যাবে না! বরং এর বিপরীতে যে সকল আলিম لاعبرة لاختلاف المطالع বক্তব্যকে হানাফী মাযহাবের বা অন্য মাযহাবের অগ্রগণ্য সিদ্ধান্ত মনে করেছেন তাদেরকেই যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, সারা বিশ্বে নয়, বরং বড় কোনো অঞ্চল জুড়ে প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদের আয়োজন করার শরয়ী বিধান কী, তখন তারা সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন, এটা ওয়াজিব তো কখনোই নয় বরং শরীয়তে এটা কাম্য বিষয়ও নয়। (এমদাদুল ফাতাওয়া খ. ২, পৃ. ১২৯)

    তো আমরা বলছিলাম, তাদের বড় দুর্বলতা এই যে, তারা কয়েক বছর আগের উদ্ভাবিত একটি প্রস্তাবকে কয়েকশ বছর আগের ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এই ভুল ধারণার ভিত্তিতে যে لاعبرة لاختلاف المطالع  বাক্যে একথাই বলা হয়েছে, অথচ বিষয়টি এমন নয়।

    ৯. কুরআন ও হাদীসে কি একই দিনে রোযা ও ঈদ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে?

    তাদের এরচেয়েও বড় দুর্বলতা হল, তারা নবউদ্ভাবিত একটি প্রস্তাব, যার সূচনাই হয়েছে বেশি দিন হয়নি, তারা একে সরাসরি কুরআন-হাদীসের হুকুম সাব্যস্ত করছেন।৩[3] তারা বলছেন, কুরআন কারীমের আয়াত ২ : ১৮৫ -এ এবং -صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته শীর্ষক হাদীসে এই হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা শুরু করতে হবে, একই দিনে রোযা শেষ করে ঈদ করতে হবে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

    জানি না, তারা সাধারণ বুদ্ধিকে কেন একটু কাজে লাগান না। যদি কোনো হুকুম কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টভাবে এসে থাকে তাহলে সেটা আর নতুন কথা হবে কীভাবে? এটা তো তাহলে আয়াত যখন নাযিল হয়েছে, হাদীস যখন ইরশাদ হয়েছে তখন থেকে মানুষের মাঝে একটা জানাশোনা বিষয় হত। অনেক পুরোনো বিষয় হত। তাফসীরের কিতাবে, হাদীসের ব্যাখ্যার কিতাবে, ফিকহের কিতাবে এর আলোচনা হত। প্রত্যেক যুগের আলিম ও ফকীহগণের মুখে এর চর্চা হত। এমন কেন হল যে, পনেরো শতকে এসে এটা আবিষ্কার করতে হল আর দলীল-প্রমাণের  খোঁজে নামা হল।

    যাই হোক, এখানে মনে হচ্ছে উক্ত আয়াত এবং উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা পূর্বাপরসহ উল্লেখ করে দিই। যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই আয়াত এবং এই হাদীসকে আলোচ্য বিষয়বস্তুতে টেনে আনা আয়াত ও হাদীসের উপর কত বড় জুলুম।

     

    ২ : ১৮৫ আয়াতের মর্ম

    কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেনÑ

    شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ،  فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ،  وَ مَنْ كَانَ مَرِیْضًا اَوْ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَیَّامٍ اُخَرَ،  یُرِیْدُ اللهُ بِكُمُ الْیُسْرَ وَ لَا یُرِیْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ  وَ لِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمْ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

    “রমযান মাসÑ যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য-মিথ্যার মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এই মাস পাবে সে যেন এই সময় অবশ্যই রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ, সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না। যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদের যে পথ দেখিয়েছেন সে জন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”

    আয়াতে কারিমায় فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ  অংশটির এক অর্থ তো এটাই, যা উক্ত তরজমা থেকে বুঝে আসছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তিই এই মাস পাবে, অন্য কথায় যে ব্যক্তিই এই মাসে উপনীত হবে সে যেন অবশ্যই এই মাসের রোযা রাখে।

    এর আরেক অর্থ এটাও হতে পারে যে, যে ব্যক্তি এই সময় ‘মুকীম’ অবস্থায় থাকবে সে যেন অবশ্যই এই মাসের রোযা রাখে।  (যে সফরে থাকবে তার জন্য ঐ সময় রোযা ফরয নয়, তার জন্য পরবর্তীতে কাযা করে নেওয়ার অনুমতি আছে।) যে অর্থই গ্রহণ করা হোক, এখানে তো দূর থেকেও এ কথা বের করা যায় না যে, বিশ্বব্যাপী একই হিলাল এবং প্রথম হিলালের ভিত্তিতে রোযা রাখা ফরয। বিশ্বব্যাপী একই তারিখে রোযা শুরু করা এবং একই তারিখে ঈদ করা ফরয। এই প্রসঙ্গ আয়াতের কোন্ শব্দ থেকে বুঝে আসে? আয়াতে তো রমযান শুরু হলে শরীয়ত পালনে আদিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা ফরযÑ এটুকুই বলা হয়েছে। রমযান কীভাবে শুরু হবে সে বিষয়ে এ আয়াত নীরব। তাহলে এ আয়াতের ঐ অর্থ কীভাবে বানানো হচ্ছে? তাদের কেউ কেউ বলেন যে, আয়াতে من শব্দটি ব্যাপকতা বুঝাচ্ছে। কিন্তু এ কথা কে অস্বীকার করে যে, من শব্দটি ব্যাপকতা বুঝাচ্ছে! من শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক।  সে কারণেই তো সকল মুসলিম নর-নারীর উপর রোযা ফরয! হাঁ, ওযরের কারণে শরীয়ত যাদেরকে অনুমতি দিয়েছে তাদের কথা ভিন্ন। এই আয়াতে সকল মুসলমানকেই রোযা রাখার হুকুম দেওয়া হয়েছে। এ থেকে এটা কীভাবে বুঝা যায় যে, প্রত্যেক এলাকার মুসলমানদের উপর একই দিনে রোযা শুরু করা ফরয। এটা তো ভিন্ন এক প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে আয়াত নীরব।

    যদি আয়াতের ইশারাই ধরা হয়, তাহলে তো শায়েখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আলউছাইমীনের কথা মতো এ আয়াতে এদিকে ইশারা আছে যে, যে অঞ্চলে লোকেরা এখনও রমযান পায়নি তাদের রোযা এখন শুরু হবে না। যখন তারা নিজেরা চাঁদ দেখার মাধ্যমে তাদের ওখানে রমযান শুরু হবে আর তারা রমযান পাবে তখনই তাদের উপর রোযা শুরু করা ফরয হবে। লক্ষ্য করুন যদি কারো রমযান না পাওয়ার বিষয়ই এখানে না থাকে তাহলে এভাবে বলার কী অর্থ যে, তোমাদের মধ্যে যারা রমযান পাবে!

    যাইহোক, এটা তো একটা সূক্ষ্ম ইশারা। এ আয়াতে এর সম্ভাবনা আছে বটে! কিন্তু এই আয়াতের সুস্পষ্ট যে অর্থ, তা হল, রমযান শুরু হলে শরীয়ত পালনে আদিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রোযা ফরয।  উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য কি ধর্তব্য নয় এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো হুকুম না এই আয়াতে আছে, না অন্য কোনো আয়াতে! এটা তো এক মুজতাহাদ ফীহ (ইজতিহাদ নির্ভর) মাসআলা। ফকীহগণ এই বিষয়ে ইজতিহাদের পথ অবলম্বন করেছেন এবং তাতে তাদের মাঝে মতভিন্নতাও হয়েছে। এই আয়াতের উদ্দিষ্ট মর্মের মধ্যে উদয়স্থলের বিভিন্নতার মাসআলা সরাসরি দাখিল করা ভুল। আর এই দাবি করা তো অনেক দূরের কথা যে, এই আয়াতে একই হিলাল ও প্রথম হিলালের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। নাউযুবিল্লাহিল আযীম।

    রমযান কীভাবে শুরু করতে হবে সে আলোচনা তো ২ : ১৮৯ আয়াতে এসেছে।

    یَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ  قُلْ هِیَ مَوَاقِیْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ

    অর্থাৎ মানুষ আপনাকে হিলালসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন সেগুলো মানুষের জন্য (অর্থাৎ তাদের ইবাদত ও লেনদেনের জন্য, বিশেষ করে) হজ্বের জন্য সময় নিরূপণের মাধ্যম।

    তো রমযান কীভাবে শুরু হবে তার বিবরণ এই আয়াতে এবং হাদীস শরীফে এসেছে। লক্ষ্য করুন! এ আয়াত এবং যেসব হাদীসকে এই আয়াতের ব্যাখ্যা বলা হয়েছে, কোথাও এ কথা  নেই যে, ইসলামী মাসসমূহের শরয়ী সূচনা সমগ্র বিশ্বে একই সাথে করা জরুরি এবং একই হিলালের দেখার ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা জরুরি! হিলালের মাধ্যমে সময় নির্ধারণের ফায়দা সৃষ্টির সূচনা থেকেই মানুষ লাভ করে আসছে। ইসলামে রোযা ফরয হওয়ার সময় থেকেই মানুষ হিলালের মাধ্যমেই রোযার সময়, রমযানের শুরু ও শেষ নির্ধারণ করে আসছে। কখনোই তো তাদের কল্পনায়ও এ কথা আসেনি যে, এই আয়াতে বিশ্বব্যাপী এবং প্রথম দেখা হিলালের ভিত্তিতেই সময় নির্ধারণ করা এবং এক হিলাল ও প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা শুরু করা এবং ঈদ করা ফরয করা হয়েছে। বড় আশ্চর্যের কথা যে, আয়াত নাযিল হওয়ার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ আয়াতের উপর যেভাবে আমল করে এসেছে তা আয়াতের মর্ম নয়। আর যে কথা কালকের সৃষ্ট আর তাও আবার নিছক চিন্তা ও দর্শনের আকারেই রয়ে গেছে, সেটাই নাকি আয়াতের উদ্দিষ্ট অর্থ!!

    কুরআনের তাফসীরের কোনো এক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও কি এই নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার একটি উদ্ধৃতি পেশ করা সম্ভব? সালাফে সালেহীনের নির্ভরযোগ্য কোনো এক কিতাবেও কি এই নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার একটিও উদ্ধৃতি পেশ করা সম্ভব? কোনো সন্দেহ নেই যে, তা কোনোদিনই সম্ভব নয়!

    এবার হাদীস শরীফের ভাষ্যটি লক্ষ্য করুন :

    হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছেÑ

    إن الله تبارك و تعالى جعل الأهلة مواقيت للناس، فصوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته، فإن غم عليكم فعدوا له ثلاثين يوما.

    নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা হিলালকে মানুষের জন্য মীকাত (সময় নিরূপণের মাধ্যম) বানিয়েছেন। সুতরাং তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়। যদি হিলাল দেখা না যায় তাহলে (চলতি মাসের) ত্রিশ দিন গণনা কর! Ñমুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক বিন হাম্মাম (১২৬-২১১ হি.), খ. ৪, পৃ. ১৫৬, হাদীস ৭৩০৬; আসসুনানুল কুবরা বাইহাকী, খ. ৪, পৃ. ২০৫; আলমুসতাদরাক, হাকেম আবু আব্দুল্লাহ, খ. ১, পৃ. ৪২২, হাদীস ১৫৭৯; আস সহীহ, ইমাম ইবনে খুযাইমা (২২২-৩১১হি.) খ. ৩, পৃ. ২০১, হাদীস ১৯০৬)

    উক্ত হাদীসে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, হিলাল দেখে রমযান মাস শুরু হবে। পরবর্তী হিলাল দেখে রমযান মাস শেষ হবে। এই জন্য হিলাল দেখে রোযা শুরু করতে হবে। হিলাল দেখে রোযা শেষ করতে হবে। যদি হিলাল দেখা না যায় তাহলে চলতি মাস ত্রিশ দিন গণনা করতে হবে। এই হল, হাদীসের মর্ম। তো এখানে কোথায় আছে যে, বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এক হিলাল এবং প্রথম হিলাল দেখে একই দিনে রোযা শুরু করতে হবে। একই দিনে ঈদ করতে হবে? আবার বলা হচ্ছে, ‘তা শুধু সওয়াবের কাজ তাই নয়, বরং এটা করা ফরয। অন্যথায় ফরয রোযা ছেড়ে দেওয়ার কবীরা গুনাহ এবং ঈদের দিনে রোযা রাখার গুনাহ তাদের উপর আসবে’। এতসব কথা উক্ত হাদীসের কোন্ শব্দ আর কোন্ বাক্য থেকে বের হল? আসলে তা নব উদ্ভাবিত বিষয়কে হাদীসের উপর চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী?৪[4]

    তারা বলেন,  صوموا لرؤيته-এর মধ্যে صوموا (তোমরা রোযা রাখ) হচ্ছে আদেশসূচক সম্বোধন এবং বহুবচনের শব্দ। এতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে হুকুম করেছেন যে, তারা যেন হিলাল দেখে রোযা রাখে! এই কথা শত ভাগ সঠিক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই জন্যই সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমানদের উপর রোযা ফরয। কোনো অঞ্চলের মুসলমানরাই এই হুকুমের বাইরে নয়। সবার উপরই রোযা ফরয। আর হিলাল দেখার পরই রোযা ফরয । কারও জন্য এটা জায়েয নেই যে, হিলাল দেখা ছাড়া শুধু হিলালের সম্ভাবনার ভিত্তিতে মাস শুরু করবে এবং এটা জায়েয নেই যে, হিলাল দেখা বাদ দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে মাস শুরু করবে। রোযা সব অঞ্চলের সব মুসলমানের উপর ফরয। আর হিলাল দেখার পরই রোযা ফরয, এর আগে নয়।

    এ হল হাদীসের সরল অর্থ। এখানে এ কথা কোত্থেকে এল যে, বিশ্বব্যাপী সমস্ত মুসলমানকে একই হিলাল এবং প্রথম হিলালের অথবা বিশেষ কোনো অঞ্চলের হিলালের ভিত্তিতে একই তারিখে রোযা শুরু ফরয? বহুবচনের শব্দ দিয়ে সবাইকে রোযা রাখতে বলা হয়েছে। সেখান থেকে এটা কীভাবে সাব্যস্ত হল যে, সবার রোযার সূচনা একই তারিখে হওয়া জরুরি। আচ্ছা أقيموا الصلاة (তোমরা নামায আদায় কর) এ কথার অর্থ কি এই যে, সবাই একই সময়ে নামায আদায় কর? অথবা آتوا الزكاة (তোমরা যাকাত আদায় কর) এর অর্থ কি এই যে, সবাই একই তারিখে যাকাত আদায় কর? أقيموا ও آتوا শব্দদ্বয় সম্বোধনসূচক বহুবচন। উভয় শব্দের সম্বোধনই ব্যাপক। বিশ্বের সকলকে সম্বোধন করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে কি এ অর্থ হতে পারে যে, সবাই একই সময়ে নামায আদায় কর, সবাই একই তারিখে যাকাত আদায় কর? ওখানে যদি এ অর্থ হয় যে, সবাই নিজ নিজ সময়ে নামায আদায় কর এবং সবাই নিজ নিজ নেসাবের বছর পূর্ণ হলে যাকাত আদায় কর, তাহলে صوموا لرؤيته -এর ক্ষেত্রে কেন এই অর্থ হবে না যে, সকল মানুষ নিজ নিজ অঞ্চলের হিলাল দেখে রোযা শুরু করবে।

    সুতরাং এ কথা বলা যে, ‘صوموا’ বলে সব অঞ্চলের সমস্ত মুসলমানকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর সে জন্য বিশ্বব্যাপী এক হিলাল এবং প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে সমস্ত মুসলমানের উপর রোযা শুরু করা ফরয’Ñ সম্পূর্ণ ভুল। সম্বোধন সবাইকে করা হয়েছে এ কথা তো ঠিক আছে, কিন্তু শুধু ‘হিলাল দেখা’ এতটুকু বিধানের সাথে তারা যে এক হিলাল দেখা এবং প্রথম হিলাল দেখা অথবা সৌদিআরবের হিলাল দেখার কথা বলছেন তা তো হাদীসে নেই। এসব তো তাঁদের সংযোজন। শরীয়তের কোনো দলীলের আলোকে তাঁরা হাদীসের মর্মের মধ্যে এসব কথা যুক্ত করছেন? জানা কথা যে, এসব তাঁদের নিজেদের থেকে সংযোজন। এসব না কোনো আয়াতে আছে, না কোনো হাদীসে!

    হিলাল দেখার সাক্ষ্যের হাদীসসমূহ থেকে কি এ কথা প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা ফরয?

    তারা এটাও দাবি করেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এলাকা থেকে আগত হিলালের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করেছেন। তাহলে বুঝা গেল, যে কোনো এলাকাতে হিলাল দেখা গেলে সব এলাকায় রোযা ও ঈদ করা উচিত।

     

    পর্যালোচনা : হিলাল দেখার সাক্ষ্য কবুল করার হাদীসসমূহের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। শা‘বানের ২৯ তারিখ, রমযানের ২৯ তারিখ, অথবা যিলকদের ২৯ তারিখ এসব তারিখে কখনো কি এমন হয়েছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিলাল দেখার জন্য অথবা হিলালের সংবাদ বা সাক্ষ্য সংগ্রহ করার জন্য এক দিন দূরত্ব নয়; পাঁচ-দশ মাইল দূরত্বের কোনো এলাকায়ও কোনো লোক পাঠিয়েছেন? হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে এর একটিও কি দৃষ্টান্ত আছে? উত্তর না-বাচক ছাড়া আর কী? খুব ভালো করে চিন্তা করা দরকার, এক হল সাক্ষ্য এসে গেলে সাক্ষ্য কবুল করা, আরেক হল সাক্ষ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। একই হিলাল এবং প্রথম হিলালের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করা যদি কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে নতুন চাঁদের সংবাদ এবং সাক্ষ্য সংগ্রহ করাও তো ফরয হবে। কিন্তু নবী-যুগে এর উপর আমল হল না কেন?  এসে যাওয়া সাক্ষ্য গ্রহণেই কেন ক্ষ্যান্ত থাকা হল?

    সুতরাং মদীনা মুনাওয়ারার আশেপাশেও কাউকে না পাঠানো এবং মদীনায় হিলাল দেখা গেলেই রোযা শুরু করা /ঈদ করা এবং মদীনায় হিলাল দেখা না গেলে রোযা শুরু না করা এবং শাওয়ালের হিলাল দেখা না গেলে ত্রিশ রোযা পূর্ণ করা, এগুলোই তো দলীল যে, নিজ নিজ এলাকার হিলাল দেখার ভিত্তিতে আমল করলেই মানুষ দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়।

    ভূমিকাস্বরূপ এই প্রয়োজনীয় কথাগুলো মনে রেখে এবার চাঁদ দেখার সাক্ষ্যের হাদীসগুলো নিয়ে চিন্তা করুনÑ

    ক. এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিআল্লাহু আনহুর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা রাখার ঘটনা এসেছে। স্পষ্টই যে, এখানে খোদ মদীনার অধিবাসীদেরই এক ব্যক্তির সাক্ষ্য অনুযায়ী রোযা রাখা হয়েছে।

    খ. আরেক হাদীসে এসেছে যে, এক বেদুঈন হাররা থেকে এসে রমযানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিয়েছে এবং সেই সাক্ষ্য গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। হাররা আজকাল তো মদীনা মুনাওয়ারারই অংশ। মাসজিদে নববী থেকে হাররা মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার দূরত্বে।

    গ. আরেক হাদীসে দুই বেদুঈনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ঈদ করার ঘটনা এসেছে। এতে একথার উল্লেখ নেই যে, এই দুই বেদুঈন কোথা হতে এসেছে। কিন্তু বেদুঈনদের বসতি মদীনার আশপাশেই ছিল। এবং এরা সকাল সকাল এসে সাক্ষ্য দিয়েছিল। এটাও তো তাহলে মদীনা থেকে একেবারে কাছের এলাকারই সাক্ষ্য হল।

    ঘ. মুসনাদে আহমদ এবং সুনানে ইবনে মাজাহ-এ একটি ঘটনা এমনও বর্ণিত হয়েছে যে, একবার ঊনত্রিশে রমযান সন্ধ্যায় হিলাল দেখা গেল না, তাই সবাই ত্রিশ রমযানের রোযা রাখলেন। দিনের শেষে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক কাফেলা এল। তারা সাক্ষ্য দিল যে, গতকাল সন্ধ্যায় তারা হিলাল দেখেছে, নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ভেঙ্গে ফেলার এবং পরের দিন ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আদেশ করলেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৫৮৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৫৩)

    তো এই কাফেলা কতই বা দূর থেকে আসবে যে, ২৯ শে রমযান সন্ধ্যায় হিলাল দেখে পরের দিন (আসরের সময়ই ধরুন) মদীনায় পৌঁছে যাবে? সেদিন হিলাল দেখার পর থেকে তারা যদি বিরামহীন লাগাতার উটের পিঠে সফর করে থাকে, তাহলে বেশির চেয়ে বেশি পঁচিশ মাইল, আরো বাড়ালে ত্রিশ মাইল দূর থেকেই হয়তো এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

    হাদীসের কিতাবসমূহে একটু দূরবর্তী এলাকা থেকে আগত সাক্ষ্য গ্রহণ করার এই একটি ঘটনাই আছে যাকে মূলত দূর বলা যায় না। ফিকহের ভাষায় এটা ‘বিলাদে মুতাকারিবা’র সংজ্ঞায় পড়ে। অপরদিকে সহীহ মুসলিমে এবং সহীহ ইবনে খুযায়মাসহ হাদীসের অন্যান্য অনেক কিতাবে সহীহ সনদে কুরাইব রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণনাকৃত প্রসিদ্ধ হাদীসটি আছে। এই হাদীসে এসেছে যে, দামেস্কে, যা তখন দারুল খিলাফাহ ছিল, সেখানে স্বয়ং আমীরুল মুমিনীনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক একদিন আগে রমযান শুরু হওয়ার সংবাদ আসলেও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু আনহু সেদিকে দৃষ্টিপাত করেননি। তিনি বলেছেন, আমরা তো শনিবার সন্ধ্যায় হিলাল দেখেছি। এইজন্য আমরা ত্রিশ রোযা পূর্ণ করব। তবে নিজেরা যদি হিলাল দেখি সেটা ভিন্ন কথা। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, মুআবিয়া রাযিআল্লাহু আনহুর হিলাল দেখা এবং রোযা রাখা কি আপনি যথেষ্ট মনে করেন না? তিনি বললেন, না, আমাদেরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই আদেশ করেছেন।

    এই হাদীস থেকে জানা গেল, অনেক দূর-দূরান্তের এলাকা থেকে হিলাল দেখার সংবাদ আসলে সেটা ভিন্ন মাসআলা। হিলাল দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করার প্রসঙ্গে এক হাদীসের বর্ণনাকারী স্বয়ং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু আনহু। এরপরও তিনি এ কথা বলছেন, তাহলে বুঝা গেল ভিন্ন এলাকার হিলালের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করা বিষয়ে দূর ও নিকটের পার্থক্য আছে।[5]

    দূর ও নিকটের পার্থক্য যদিও কতিপয় ফকীহ গ্রাহ্য করেননি, কিন্তু কোনো ফকীহ, মুজতাহিদ এই ফতোয়া দেননি যে, দূর-দূরান্তের অঞ্চল থেকে হিলাল দেখার সাক্ষ্য সংগ্রহ করে সব এলাকার জন্য সেই হিলালের বিধান বাস্তবায়ন করা জরুরি। হিলাল দেখার সাক্ষ্য গ্রহণের সমস্ত হাদীসের মর্ম ও আবেদনও এ কথার সমর্থন করে না। কেননা এসব হাদীসের প্রেক্ষাপট হল, মদীনা মুনাওয়ারা থেকে হিলাল দেখার জন্য অথবা হিলাল দেখার সাক্ষ্য সংগ্রহ করার জন্য কোনো প্রতিনিধি দলকে এদিক সেদিক পাঠানো হয়নি। যদি রোযা ও ঈদের তারিখের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টি করা জরুরি হত তাহলে অবশ্যই এটা করা হত।

     

    ঐ যামানায় কি প্রচার-ব্যবস্থা ও যোগাযোগ-ব্যবস্থা বিলকুল ছিল না?

    এর জবাবে এই কথা যেন না বলা হয় যে, ঐ যামানায় তো যোগাযোগের উন্নত ব্যবস্থা ছিল না। এই সীমাবদ্ধতার কারণে বাধ্য হয়ে তারা নিজ নিজ এলাকার  হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করত। নয়তো তাদেরও জানা ছিল যে, কুরআন-হাদীসে এক হিলাল এবং প্রথম হিলালের ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা এবং একই সাথে অন্যান্য চান্দ্রমাস  শুরু করার হুকুম দেওয়া হয়েছে!

    এ কথা এ জন্য যথাযথ হবে না যে, প্রচারব্যবস্থা ইসলামের শুরুর যুগ থেকে সব যুগে কমবেশি ছিল। প্রত্যেক যুগেই তার পূর্ববর্তী যুগ থেকে উন্নত থেকে উন্নততর ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। প্রশ্ন হল, প্রত্যেক যুগের দায়িত্বশীল ও আলিমগণ এবং  পীর ও মাশায়েখ কি নিজ নিজ সময়ের প্রচারব্যবস্থাকে সম্ভাব্য পর্যায় পর্যন্ত এই কাজে লাগিয়েছেন? উত্তর যদি না-বাচক হয়ে থাকে তাহলে চিন্তা করুনÑ আপনাদের দৃষ্টিতে তো এটা কুরআন-হাদীসের বিধান। আর ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের কথা মতে এটা কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বিধান, তাহলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান সম্পর্কে ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহকগণ, যারা নবীগণের ওয়ারিস তারা কীভাবে অবহেলা-উদাসীনতা প্রদর্শন করতে পারেন?

    ঐ যামানায় প্রচলিত প্রচারমাধ্যম এবং যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে আমরা শুধু নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর আলোচনা করতে চাই :

    ১. দূত পাঠানো

    ২. হাতে হাতে চিঠি পাঠানো

    এখানে এই আপত্তির সুযোগ নেই যে, ২৯ শে শাবান সন্ধ্যায় হিলাল দেখে পরের দিন সকালে রোযা রাখার  সংবাদ এবং ২৯ শে রমযান সন্ধ্যায় হিলাল দেখে পরের দিন ঈদ করার সংবাদ দূত মাধ্যমে বা হাতে হাতে চিঠির মাধ্যমে কত দূর আর পৌঁছানো সম্ভব?

    চতুর্র্দিকে দশ মাইল পর্যন্তও যদি পৌঁছানো যায় তবু সেটা কম কীসে? এইটুকু অঞ্চলের বাসিন্দারা অন্তত প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে আমল করা থেকে মাহরূম থাকতো না। এরপরে বিষয় তো শুধু হিলাল দেখার সংবাদ রাতের মধ্যেই পৌঁছানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। যদি পহেলা শাওয়াল আছর পর্যন্তও সংবাদ পৌঁছে যায়, তবুও তো সবাই ঈদের দিন রোযা রাখার গুনাহ থেকে বেঁচে যেত। আর পরের দিন ঈদের নামায পড়ে নিত। এমনিভাবে দূর-দূরান্তে ২৭ শে রমযান পর্যন্তও যদি খবর  পৌঁছে যায় তাহলে তো সবাই সঠিক ২৯ তারিখ নির্ধারণ করতে পারবে। একটি রোযা কাযা করতে হবে, তা জানতে পারবে। পঁচিশ রমযানে খবর পৌঁছলে তো সঠিক ২৭-এর রাতও নির্ধারণ করতে পারবে। আর ঈদুল আযহা, কুরবানী, তাকবীরে তাশরীক ও শবে বরাত এসব তারিখের ক্ষেত্রে তো দূত এবং চিঠির ব্যবস্থা শত শত মাইল পর্যন্ত কাজে আসতে পারতো।

    ৩. ডাকযোগে পাঠানো

    ডাকের ব্যবস্থা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহুর যামানায়ও ছিল। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা অনেক উন্নতি করেছে। খেলাফতে বনু উমাইয়া এবং খেলাফতে আব্বাসিয়ার সময়ে তো এই ব্যবস্থা অনেক অনেক উন্নতি করেছে। আরবে ‘ঘোড়ার ডাক’ অনেক প্রাচীন। ডাকপিয়ন সাধারণ মুসাফিরদের মত সফর করতো না যে, দিনে চলত আর রাতে বিশ্রাম নিত। বরং ডাকপিয়নের রাতদিন লাগাতার সফর করতে হত। কয়েক মাইল পর পর তাজাদম ঘোড়া প্রস্তুত থাকত। যেন ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে ডাক পৌঁছতে বিলম্ব না হয়ে যায়। এভাবে অনেক দীর্ঘ পথও ডাকপিয়ন সংক্ষিপ্ত সময়ে অতিক্রম করে ফেলতো। ডাকের কথা সহীহ বুখারীতেও এসেছে। কুফার ডাকঘরে আবু মূসা আশআরী রাহ.-এর নামায আদায় করার বিবরণ সহীহ বুখারীতে (ফাতহুল বারীর নুসখা, খ. ১, পৃ. ৪০০, কিতাবুল উযু, অধ্যায় ৬৬ أبواب الإبل و الدواب و الغنم و مرابضها) এসেছে। আবু মূসা আশআরী রাযিআল্লাহু আনহু খেলাফতে রাশেদার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় যুগে কুফার গভর্নর ছিলেন। (ফাতহুল বারী, খ. ১, পৃ. ৪০১)

    আরবে ডাকব্যবস্থা প্রাচীনকালে কত উন্নত ছিল সে বিষয়ের আলোচনা الطائر الغريد في وصف البريد নামক কিতাবে দেখা যেতে পারে। নুমান আফেন্দীর ডাকের ইতিহাসের উপর লিখিত এই চমৎকার ও অনবদ্য গ্রন্থটি মিসরের  المقتطف প্রেস থেকে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ছেপে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে আগের কালে প্রচলিত ‘আকাশ-ডাকে’র এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকার ‘পায়রার ডাক’সহ অন্যান্য প্রকারের বিষয়েও আলোচনা আছে। আরো দেখুন ‘আততারাতীবুল ইদারিয়্যা’, আব্দুল হাই কাত্তানী রাহ. (খ. ১ পৃ. ১৯১-১৯৪)

    এরপর যখন চীন পারস্য এবং সিন্ধু ও হিন্দুস্তানসহ অন্যান্য অগ্রসর দেশসমূহও ইসলামের বিজিত অঞ্চলের অধীনে এসে গেছে তখন তো সেখানকার যোগাযোগ মাধ্যমও মুসলিম উম্মাহর ব্যবহারে চলে এসেছে।

    দু’টি নমুনা

    ঐতিহাসিক তাকীউদ্দীন মাকরিযী রাহ. (৮৪৫হি.)-এর ‘আলমাওয়ায়েজ ওয়াল ই‘তিবার’  খ. ১, পৃ. ৩২২) কিতাবে ইতিহাসের সেই সোনালি  অধ্যায়টিরও উল্লেখ আছে যে, ২৬১ হিজরীতে আফ্রিকায় যে সময় ইবরাহীম বিন মুহাম্মদ বিন আলআগলাবের শাসন প্রতিষ্ঠিত হল তখন তিনি সমুদ্রতীরে ধারাবাহিকভাবে কয়েক মাইল পর পর দূর্গ ও চৌকি স্থাপন করেন। তার কালে পথ ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ। ঐ সময় দূর্গে দূর্গে আগুন প্রজ্বলিত করার মাধ্যমে সাবতা থেকে ইস্কান্দরিয়া পর্যন্ত এক রাতেই সংবাদ পৌঁছে যেত। অথচ সাবতা আর ইস্কান্দারিয়ার মাঝে চার হাজার দুইশ ঊনআশি কিলোমিটারের দূরত্ব। বর্তমানে বাসেই ঊনসত্তর ঘণ্টার পথ।

    এমনিভাবে ইস্কান্দরিয়া থেকে তারাবলুসে রাতে কয়েক ঘণ্টায় খবর পৌঁছে যেত। উভয় শহরের মাঝে দূরত্ব মোট আঠার শত বিরাশী কিলোমিটার। এটা হল মুরাবিতীনের শাসন আমলের ঘটনা। দেখুন আবু মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহিদ বিন আলী আততামীমী আলমারাকেশী (৫৮১-৬৪৭)-এর কিতাব ‘আলমুজিব ফি তালখীসী আখবারিল মাগারিব’, পৃ. ২৫০

    প্রশ্ন হল, আমাদের পূর্বসূরীদের যুগে, বিশেষত সোনালী তিন যুগে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় আদান-প্রদানের জন্য কোনো মাধ্যম কি ব্যবহার করা হয়েছিল? উত্তর যদি না-বাচক হয়ে থাকে তাহলে এর কারণ কী? দ্বীনের বিষয়ে তারা শিথিলতা করতেন বলে কেউ যদি অপবাদ দেয়, সে তো নিজেই নিজের ঈমান বরবাদ করবে, আখেরাত নষ্ট করবে। তাহলে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া কি কোনো উপায় আছে যে, আসলে ইসলাম যেহেতু মানব-স্বভাবের অনুকূল ধর্ম, এতে সবক্ষেত্রে সব যুগের এবং সব এলাকার মানুষের সহজতার দিক লক্ষ্য করা হয়েছে। তাই ইসলামী শরীয়তে এই হুকুম দেওয়াই হয়নি যে, হোক না হোক বিশ্বব্যাপী সমস্ত মানুষ যেন তাদের চান্দ্রমাস একই দিনে শুরু করে! একই দিনে রোযা ও ঈদ করে!  সেই জন্যই তো ইসলামের সাড়ে চৌদ্দশত বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এর একটাও নযীর পাওয়া যায় না। এর নযীর তো পাওয়া যায়ই না, যা পাওয়া যায় তা হল, খেলাফতে রাশেদার যুগে খেলাফতের অধীন সমস্ত এলাকায় এটা লিখে পাঠানো হয়েছে যে, তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ। হিলাল দেখেই রোযা শেষ কর। এই প্রসঙ্গে হযরত উমর রাযিআল্লাহু আনহু  সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানদের নিকট যে পত্র লিখতেন তা খতীব বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উদ্ধৃতিতে ইমাম নববী রাহমাতুল্লাহি ‘শরহুল মুহাযযাব’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। (খ. ৭ পৃ. ৬৪৯-৬৫০) আরেকটি ফরমান মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাতেও আছে। এই প্রসঙ্গে শা‘বানের শেষে সালাফের খুতবা ও বক্তৃতা দেখা যেতে পারে। কেউ মদীনায় বলছেন صوموا لرؤيته, কেউ দামেশকে বলছেন صوموا لرؤيته। প্রতিটি খুতবাতে একই কথা যে, صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ। হিলাল দেখে রোযা ছাড়। এসবের নিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী অর্থ কি এই নয় যে, তারা এবং তাদের শ্রোতারা এই হাদীস থেকে নিজ নিজ এলাকার হিলাল দেখার অর্থই বুঝেছেন!

     

    নব উদ্ভাবিত এই প্রস্তাব সামনে আসার পর আলিমগণ কী বলেছেন?

    রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে চলে আসা এখনও পর্যন্ত বহাল ও বলবৎ এই সুন্নতে মুতাওয়ারাসার বিপরীতে যখন কতিপয় যুক্তিবাদী লোকের পক্ষ থেকে তথাকথিত ঐক্যের  আওয়াজ উঠল তখন আহলে হক আলিমগণ যথাসময়ে এর প্রতিবাদ করেছেন এবং তাদের উত্থাপিত যুক্তিসমূহের বাস্তবতা উন্মোচন করে দিয়েছেন।

     

    ১. ইবনে আব্দুর রাযযাক রাহ.

    هل يمكن اتحاد الشمال الأفريقي مواسم وأعيادا

    (গোটা উত্তর আফ্রিকায় একই দিনে ঈদ করা কি সম্ভব?) এবং

    هل يمكن توحيد الأعياد الدينية في الأقطار الإسلامية

    (গোটা মুসলিম বিশ্বে দ্বীনী পর্বসমূহের তারিখের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টি করা কি সম্ভব?) প্রথম শিরোনামে যখন আলমাগরিব পত্রিকায় ৫ম সংখ্যা ১০ মুহাররম ১৩৬৩ হি. মোতাবেক ৭ জানুয়ারি ১৯৪৪ ঈ.-এ এবং দ্বিতীয় শিরোনামে আলইলম পত্রিকায় ৫২তম সংখ্যা ১৫ই যিলহজ্ব ১৩৫৫ হি. মোতাবেক ১০ নভেম্বর ১৯৪৬ ঈ. দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল তখন এর বিস্তারিত খণ্ডন লিখেছেন মরক্কোর বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলেম আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে আব্দুর রাযযাক (১৯০৬-২০১১ঈ.)। যা তার কিতাব العذب الزلال في مباحث رؤية الهلال -এ যুক্ত আছে। (পৃষ্ঠা : ১৭৪-২০৭) এই কিতাব কাতারের ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে বড় বড় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮৩৪, রচনাকাল : মুহাররম ১৩৬৭ হি. মুতাবেক ডিসেম্বর ১৯৪৭ঈ.

    العذب الزلال  -এর উপর অনেক বড় বড় মণীষী আলিমগণের অভিমত আছে। যা কিতাবের শেষে ছাপা হয়েছে।

     

    ২. শায়খ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ, হারামুল মাক্কীর সাবেক ইমাম

    শায়খ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ রাহ.-ও এ মতবাদকে তার কিতাব >تبيان الأدلة في إثبات الأهلة< -এ প্রমাণিক খ-ন করেছেন। শায়েখের এ কিতাবের উর্দূ তরজমা ‘আলফুরকান’ পত্রিকায় Ñযা মাসলাকে দেওবন্দের মূখপত্রÑ প্রকাশিত হয়েছে। এমনিভাবে উলামায়ে আহলে হাদীসও পাকিস্তানে এ কিতাবের উর্দূ তরজমা প্রকাশ করেছেন।

     

    ৩. রাবেতার ফিকহ একাডেমী

    পরে যখন কিছু লোকের পক্ষ থেকে   আবার একই তাকাযা পেশ করা হয়, তখন রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামী (ফিকহ একাডেমী, মক্কা মুকাররমা) এর খ-ন করে এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে :

    لا حاجة إلى توحيد الأهلة والأعياد في العالم الإسلامي، لأن توحيدها لا يكفل وحدتهم، كما يتوهمه كثير من المقترحين لتوحيد الأهلة والأعياد. وأن تترك قضية إثبات الهلال إلى دور الإفتاء والقضاة في الدول الإسلامية، لأن ذلك أولى وأجدر بالمصلحة الإسلامية العامة، وأن الذي يكفل توحيد الأمة وجمع كلمتها، هو اتفاقهم على العمل بكتاب الله وسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم في جميع شؤونهم.

    মুসলিম জাহানে হিলাল ও ঈদ এক করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তা মুসলিমদের ঐক্য নিশ্চিত করবে না যেমনটা হিলাল ও ঈদ এক করার অনেক প্রস্তাবকের ধারণা। হিলাল প্রমাণ হওয়ার বিষয়টি ইসলামী দেশগুলোর কাযা ও ফতোয়া বিভাগগুলোর উপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন। কারণ এটিই ইসলামের সাধারণ কল্যাণ বিবেচনায় অধিকতর উত্তম ও উপযোগী।

    আর যে বিষয়টি উম্মাহর ঐক্য নিশ্চিত করবে তা হচ্ছে, সকল বিষয়ে আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার বিষয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়া।’’ (কারারাতুল মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, মক্কা মুকাররমা, পৃষ্ঠা : ৮৭-৮৯)

    রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর ‘আলমাজমাউল ফিকহী’-এর ঐ অধিবেশনে, যাতে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, পুরো বিশ্বের এবং সকল মাযহাবের বড় বড় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্তে  স্বাক্ষরকারীদের নাম আমরা আলকাউসার শাওয়াল ১৪৩৪ হি. (আগস্ট ২০১৩ঈ.) সংখ্যায় পড়েছি।

     

    ৪. শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

    শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৩১১-১৩৮৯ হি.) যিনি শায়খ বিন বায রাহমাতুল্লাহি আলাইহির আগে সৌদিআরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রবিউল আউয়াল ১৩৭৭ হিজরীতে জামিয়াতুদ দুয়ালিল আরাবিয়্যার পক্ষ থেকে তার সামনে ‘তাওহীদুল আহিল্লার’ (হিলাল এক করা) বিষয়ে সেমিনারের প্রস্তাব পেশ করা হয়, তখন তিনি এতে সম্মত হননি।

    তাঁর উত্তরের সারকথা হল, এটি এমন কোনো বিষয় নয়, যার জন্য সেমিনার ডাকা কাম্য। এটা তো একটা শাখাগত মাসআলা। صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته শীর্ষক হাদীসের মধ্যেই এর ফায়সালা আছে। এই হাদীসের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য হয়েছে (এক অঞ্চলের হিলাল দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্যগ্রহণীয় কি না) সেটা অন্যান্য শাখাগত মতপার্থক্যের মতই। এই মতপার্থক্যে কোনো ক্ষতি নেই।

    আসল কথা তো হল, গোটা উম্মত তাওহীদে উলূহিয়্যাত এবং তাওহীদে রুবূবিয়্যাতের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া। পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহকে একমাত্র সিদ্ধান্তদানকারী হিসেবে গ্রহণে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। মজলিস তো এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য হওয়া উচিত।

    সুতরাং রোযা ও ঈদের হিলালের বিষয়ে (তাওহীদুল আহিল্লাহর প্রস্তাব) উক্ত মজলিসের সাথে একমত নই। আমার দৃষ্টিতে এ জন্য মজলিসের প্রয়োজন  নেই, মুসলিম উম্মাহ সুদীর্ঘ চৌদ্দ শতাব্দী অতিবাহিত করল, রোযা ও ঈদের মধ্যে তারিখের পার্থক্য ছিল, কিন্তু তারা একে ক্ষতিকর মনে করেননি। আর না তারা এর জন্য সেমিনার আহ্বান করার প্রয়োজন বোধ করেছেন! (ফতোয়া ওয়া রাসাইলি সামাহাতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শায়খ, খ. ৪, পৃ. ১৫৫-১৫৮, ফতোয়া নাম্বার : ১০৯৬)

    এই বিষয়ে রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর ফিকহ একাডেমীর বিবৃতি একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সৌদি আরবের হাইয়াতু কিবারিল উলামার সুপারিশ আমরা আলকাউসার শাওয়াল ১৪৩৪ হি. (আগস্ট ২০১৩ঈ.) সংখ্যায় পড়েছি।

     

    ৫. হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.

    হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. এই বিষয়ে যে সারৎসার ও অনবদ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন তা তাঁর পুস্তিকা ‘রুইয়াতে হিলালে’র পৃষ্ঠা : ১১-১২, ৩২-৩৭ -এ বিদ্যমান আছে। যার বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

     

    ৬. হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসূফ বিন্নুরী রাহ.

    হযরত রাহ.-এর তিরমিযীর শরাহ ‘মাআরেফুস সুনান’ দেখা যেতে পারে। তিনি সেখানে ‘তাওহীদুল আহিল্লা’র মতকে শরীয়তের মেযাজের খেলাফ বলেছেন।

     

    ৭. মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরিয়াবাদী রাহ.

    মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরিয়াবাদী রাহ. মাওলানা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ ব্যক্তিত্ব। যে বন্ধুরা সবসময় বুদ্ধির কথা বলেন, তাদের তো তাঁর কথার প্রতি মান্যতা থাকা চাই। বিশ্বব্যাপী নয়, শুধু ভারতব্যাপী একই তারিখে রোযা ও ঈদের জবরদস্তি করার উপর তিনি কী রকম সমালোচনা করেছেন তা তার তাফসীরে মাজেদী খ. ১, পৃ. ৩৩৮-৩৪০ আয়াত (২ 🙂 ১৮৫ এ দেখা যেতে পারে। এই কিতাবের উর্দূ ও ইংরেজী উভয় সংস্করণই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এর বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

     

    ৮. মাওলানা আব্দুর রহমান কীলানী রাহ.

    আহলে হাদীস ঘরানার বড় আলেম, মাওলানা আব্দুর রহমান কীলানী রাহ. (১৯২৩-১৯৯৫ঈ.) তার কিতাব الشمس والقمر بحسبان (اسلام كا نظام فلكيات)  -এর পঞ্চম অধ্যায়ে (উদয়স্থলের বিভিন্নতা এবং ইসলামী পর্ব-উৎসবে ঐক্যের প্রচেষ্টা) শিরোনামে তিনি সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। পরিশেষে তিনি লেখেনÑ

    ‘…হযরত উমর রাযিআল্লাহু আনহুর মত চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব, যিনি জনসাধারণের সহজতার জন্য অসংখ্য  নীতি ও ব্যবস্থার উদ্ভাবক বলে স্বীকৃত। তিনি মদীনা মুনাওয়ারা থেকে হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত সা¤্রাজ্য সুন্দর ও সঠিকভাবে শাসন করেছেন। তিনি যদি ভালো মনে করতেন তাহলে কি মুসলমানদের এই ঐক্যের জন্য ব্যবস্থা না নিয়ে পারতেন? তিনি তো কথায় কথায় মজলিসে শূরা ডেকে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত জারী করতেন কিন্তু কখনোই ঈদ বা রমযানের ঐক্যের মাসআলা তাঁর আলোচনায় আসেনি! ঐ স্বর্ণযুগে যদি এর কোনো নযীর না পাওয়া যায়, তাহলে এখন অনেক বছর পরে এসে এ বিষয়ে কেন এত চাপাচাপি?

    ইসলামের দুই ঈদ, ইবাদত এবং শোকরের নামায আদায়। ইসলামে ঈদ উৎসব পালনের জন্য নয়। তাই ঈদের ক্ষেত্রে ঈদের নামায (ফিতরা ও কুরবানী) ছাড়া আর কোনো বিধান ইসলামে দেওয়া হয়নি।

    মুসলিম  ঐক্যের জন্য ইসলাম যে বিষয়গুলোর তাকীদ করেছে সেগুলোর মধ্যে হল, দলীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেঁচে থাকা। ফরয নামায জামাতের সাথে আদায় করা, যাকাত-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, হজ্বের সম্মিলন ইত্যাদিসহ আরো বিষয়। এসব বিষয়ে তো মুসলমানদের কোনো মনোযোগ নেই। শুধু অন্যান্য ধর্মের দেখাদেখি ধর্মীয় আবেগের সর্বোচ্চ সীমা কেবল উৎসব উদযাপনÑ ঈদ ও অন্যান্য পর্বের তারিখ এক করার আওয়াজ তোলা। বস্তুত ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনতার প্রকাশ যে, মানুষ জরুরি বিষয়গুলোর দিকে নযর দেয় না। নিজের সমস্ত শক্তি অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক কাজে ব্যয় করে। (ইসলাম কা নেযামে ফালাকিয়্যাত,  মাওলানা আব্দুর রহমান কীলানী, মাকতাবাতুস সালাম, লাহোর, পৃষ্ঠা: ৭৯)

     

    ৯. হাফেজ সালাহুদ্দীন ইউসুফ

    আহলে হাদীস ঘরানার আরেকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হাফেজ সালাহুদ্দীন ইউসুফ তাঁর কিতাব مسألۂ رؤیت ہلال اور بارہ اسلامی مہینے  -এর মধ্যে বিশদ আলোচনা শেষে সারসংক্ষেপে লেখেনÑ ‘মুসলিম বিশ্বে একই দিনে ঈদ পালন করা, রমযান ও অন্যান্য মাস একই দিনে সূচনার যে মতবাদ, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও দলীলবিহীন। সৌদিআরবের হিলাল দেখাকেও এক্ষেত্রে ভিত্তি বানানো যাবে না।’ (পৃষ্ঠা: ১৫৩, দারুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল)

     

    ১০. পীর করম শাহ আজহারী

    তিনি তার তাফসীরগ্রন্থ ‘যিয়াউল কুরআন’  খ. ১ পৃ. ১২৫-এ লেখেনÑ

    কারণ, উদয়স্থলের ভিন্নতা একটি স্বীকৃত বিষয়। এ কারণে ফকীহগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যদি দূর-দূরান্তের অঞ্চলে চাঁদ দেখা যায় তাহলে তা ধর্তব্য হবে না।

    إن البلاد إذا تباعدت كتباعد الشام من الحجاز، فالواجب على أهل كل بلد أن تعمل على رؤيته دون رؤية غيره. (قرطبي)

    (প্রকাশক যিয়াউল কুরআন পাবলিকেশন্স, গঞ্জ বখশ রোড লাহোর, মুদ্রণকাল: ১৯৯৫ ঈ.)

     

    ১১. ড. ইউসূফ আলকারযাভী

    আল্লামা ড. ইউসুফ কারযাভী রাহ. প্রথমে যা কিছুই লিখে থাকুন সম্প্রতি ২০১৬ ঈ. ইস্তাম্বুলে হিজরী ক্যালেন্ডারের উপর যে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় তাতে তিনি পরিষ্কার বলেছেন যে, কুরআন-হাদীসে কোথাও নেই যে, গোটা দুনিয়ায় একই দিনে রোযা ও ঈদ করতে হবে।

    সেমিনারের পর সাক্ষাৎকারে আরো বলেছেন, মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার স্থানগত ও সময়গত এত দূরত্ব থাকা অবস্থায় চাঁদসমূহ এক করার চিন্তা সম্পূর্ণ অর্থহীন। দেখুন:

    http://www.huffpostarabi.com/2016/05/30/story_n_10203036.html

    মোটকথা, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করার মতবাদ একটি নতুন বিষয়। চার মাযহাবেরই অধিকাংশ আলেম এবং এই উপমহাদেশের দেওবন্দী, বেরলভী ও আহলে হাদীস, সকল ঘরানার অধিকাংশ আলেম একে এক অপ্রয়োজনীয় বরং ভিত্তিহীন প্রচেষ্টা গণ্য করেছেন। আর এ প্রয়াসকে বিশেষ কোনো সওয়াবের কাজ মনে করা হলে তা বিদআত হওয়ার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বীনের ইলম এবং শরীয়তের রুচি-প্রকৃতি সম্পর্কে বেখবর থাকার কারণে যারা একে ফরয বা ওয়াজিব বলতে চান, তারা তো বুঝে অথবা না বুঝে শরীয়তের বিকৃতিতে লিপ্ত।

    প্রকাশ থাকে যে, যারা একই দিনে রোযা ও ঈদকে ফরয বা ওয়াজিব বলার প্রবক্তা, মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর (জিদ্দা ফিকহ একাডেমী) সুপারিশে তাদের এই মতের পক্ষে কোনো দলীল নেই।

     

    জ্যোতির্বিদগণ কী বলেন?

    তাদের উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে আপত্তি হল, ‘আলিমরা বিজ্ঞান জানে না, জ্যোতির্বিজ্ঞান বুঝে না। এজন্যই মুসলিম জাতি আজ অধঃপতনের শিকার। আলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান না জানার কারণেই রোযা ও ঈদের ঐক্যের বিরোধী’! কিন্তু তাদের এই আপত্তির বাস্তবতা আজও আমাদের বুঝে আসে না! ধরে নিন, একজন মৌলবী সাহেবও জ্যোতির্বিজ্ঞান জানে না, কিন্তু আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা তো জানেন। (যদিও আফসোসের কথা হল, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দেশে এস্ট্রোনমির গবেষণার কাজ ইঞ্জিনিয়ারদেরকেই করতে হচ্ছে। দেশে আমাদের জানা মতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এস্ট্রোনমি বিভাগ নেই।) কিন্তু এরা জ্যোতির্বিজ্ঞান জানা সত্ত্বেও কেন বলেন যে,

    ১. ‘চান্দ্রমাস হয়তো ঊনত্রিশ দিন হবে, নয়তো ত্রিশ দিন’ অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে চান্দ্রমাসের সময়ের মধ্যে ভাংতি আছে।

    ২. কেন তারা বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা উচিত’, অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে বিশ্বের সব জায়গায় একই দিনে নতুন চাঁদ দেখা অসম্ভব। এ জন্যই জ্যোতির্বিজ্ঞান উদয়স্থলের বিভিন্নতা স্বীকার করে। কারণ এটা একটা বাস্তবতা।

    ৩. কেন তারা বলেন, ‘চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে লুনার ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করে সেই মোতাবেক রোযা ও ঈদ করা উচিত’। অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞান এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন থেকে চান্দ্রমাস হিসাব করে। এদিকে ইসলামের শিক্ষা হল, চান্দ্রমাস হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্য সময় থেকে নয়, দেখার মাধ্যমে শুরু হবে। এই জন্য হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে প্রস্তুতকৃত লুনার ক্যালেন্ডার মোতাবেক আমল করলে না ইসলামী শরীয়তের শিক্ষা মোতাবেক আমল হবে, না জ্যোতির্বিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসারে আমল হবে।

    মেহেরবানী করে একটু বলুন দেখি, শরীয়ত তো চান্দ্রমাসের হিসাবকে চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। এক্ষেত্রে শরীয়তের নিকট জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের কোনো ই‘তিবার নেই। তাহলে বাস্তবেই যদি আলিমগণ জ্যোতির্বিজ্ঞান না জানেন, এতে এমন কী অন্যায় হয়ে গেল যে, এর কারণে তাঁরা হিলালের সাথে সম্পৃক্ত শরীয়তের বিধান বুঝবেন না?!

    যাই হোক এখন আমরা বলতে চাচ্ছি, তারা তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আলিমগণের সাথে মতানৈক্যে লিপ্ত হচ্ছেন। অথচ আমরা দেখি যে, হিলাল দেখার মাসআলায়ও এবং একই তারিখে রোযা ও ঈদ করার ইস্যুতেও বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলিমগণের সাথেই আছেন।

    দ্বীনী বিষয় বিশেষত রোযা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, হজ্ব ও কুরবানী ইত্যাদির ক্ষেত্রে হিলাল দেখার ভিত্তিতেই চান্দ্রমাসের হিসাব হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে নয়।

    এখানে আমরা শুধু দরসে নেযামীর পাঠ্যভুক্ত একটি কিতাবের পাঠ উল্লেখ করছি। ‘দরসে নেযামী’ আমাদের উপমহাদেশের সমস্ত মাদরাসার নেসাবের ভিত্তি। কিতাবটির নাম হল ‘শরহে চিগমিনী’। এটি মূসা পাশা বিন মুহাম্মাদ (৮৯৯হি.)-এর রচনা। যা মাহমূদ বিন উমর চিগমিনী রাহ. (৬১৮হি.)-এর কিতাব ‘আলমুলাখ্খাসের’ ব্যাখ্যাগ্রন্থ। এতে আছেÑ

    وأوضح الأوضاع هوالهلال، لكن رؤية الهلال تختلف باختلاف المساكن، كما أشرنا إليه، فلم يلتفت إليها عند أهل الحساب إلا في الأمور الشرعية امتثالا لأمر الشرع.

    চাঁদের কলাসমূহের সবচেয়ে সুস্পষ্ট কলা হল, হিলাল। কিন্তু স্থানভেদে হিলাল দেখা ভিন্ন ভিন্ন হয়। এজন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হিলালের দিকে দৃষ্টিপাত করেননি। কিন্তু দ্বীনী বিষয়াদিতে শরীয়তের হুকুম তামিল করার জন্য হিলালকে গ্রহণ করেছেন। (শরহু চিগমিনী, পৃষ্ঠা: ১২৭, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া দেওবন্দ থেকে ১৩৮৭ হি.-এ মুদ্রিত)

    তো বুঝা গেল, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিজস্ব শাস্ত্রীয় পরিম-লে যদিও এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন থেকে চাঁদের হিসাব শুরু করেন কিন্তু দ্বীনী বিষয়ে যেহেতু শরীয়তের হুকুম মান্য করতে হবে আর শরীয়ত যেহেতু দ্বীনী বিষয়ে হিলাল দেখার উপর ভিত্তি রেখেছে সেহেতু তারা দ্বীনী বিষয়ের ক্ষেত্রে হিলাল দেখারই অনুসরণ করে। নিজস্ব শাস্ত্রের মর্যাদা ও ব্যবহারের ক্ষেত্র শাস্ত্রজ্ঞরা বেশি বুঝেন নাকি ভিন্ন শাস্ত্রের লোকেরা?

    এখন বলছিলাম যে, ‘আলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান বুঝে না’Ñ একে বাহানা বানিয়ে তারা বিশ্বব্যাপী একই তারিখে রোযা ও ঈদ করার প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের তো খবর নিয়ে দেখা উচিত যে, এই বিষয়ে স্বয়ং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্য কী? আমরা এখানে আগের ও পরের এবং বর্তমান সময়ের দু’চারজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি পেশ করছি :

     

    ১. আলবেরুনী (৪৪০হি.=১০৪৮ঈ.)

    আলবেরুনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হিসাব-নির্ভর লুনার ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ পালনকারী বাতিল ফিরকা বাতেনী শীয়াদের খ-ন করতে গিয়ে যে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন তার সামান্য একটি অংশ এইÑ

    فإذن لا يمكن ما ذكروه من تمام شهر رمضان أبدا ووقوع أوله وآخره في جميع المعمور من الأرض متفقا كما يخرجه الجدول الذي يستعملونه.

    অর্থ : এটা সম্ভব নয় যে, রমযান মাস সবসময় ত্রিশ দিনেই হবে এবং এটাও সম্ভব নয় যে, মাসের শুরু ও শেষ সমগ্র বিশ্বে একই তারিখে হবে। যেমনটা তাদের ক্যালেন্ডারে দেওয়া থাকে। ‘আলআসারুল বাকিয়া আনিল কুরূনিল খালিয়া, পৃষ্ঠা : ৬৬

     

    ২. ইবনে রুশদ (৫২০-৫৯৫ হি.)

    তিনি একইসাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন এবং অনেক বড় ফকীহও ছিলেন। তিনি ইলমুল ফিকহ বিষয়ে তাঁর কিতাব বিদায়াতুল মুজতাহিদ (খ. ১, পৃ. ৩৫৮)-এ লিখেছেন, দূর-দূরান্তের অঞ্চলের ক্ষেত্রে এক এলাকার হিলাল দেখা অন্য এলাকার জন্য ই‘তেবার করা হবে না। তার আরবী বক্তব্য এইÑ

    >وأجمعوا أنه لا يراعى ذلك في البلدان النائية كالأندلس والحجاز<.

    তিনি আরো লিখেছেনÑ ‘দূরবর্তী ও নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের এক অঞ্চলের হিলাল দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য ধর্তব্য হওয়া না হওয়ার পার্থক্য করা আকলেরও দাবি।’

    তার আরবী পাঠ হলÑ

    والنظر يعطي الفرق بين البلاد النائية والقريبة، وبخاصة ما كان نأيه في الطول والعرض كثيرا.

    ৩. ডক্টর হুসাইন কামালুদ্দীন (১৩৩২ হি.=১৯১৩ ইংÑ১৪০৭ হি.=১৯৮৭ ঈ.)

    প্রকৌশল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তার অবদান অনেক। মিশর ও সৌদিআরবের বড় বড় ইউনিভার্সিটিতে তিনি এ বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি دورتا الشمس  والقمر وتعيين أوائل الشهور العربية باستعمال الحساب নামে তার বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন। লক্ষণীয় বিষয় হল, তিনি তার এই কিতাবে (পৃষ্ঠা: ২৮-এ) প্রথমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে হিলালের উদয়স্থলের বিভিন্নতার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। এরপর তিনি লিখেছেন

    >وهكذا بنى الشارع على اختلاف المطالع كثيرا من الأحكام ومن أظهرها مواقيت الصلاة، ولا يجوز توحيد الصوم والأعياد لجميع أهل الأرض<.

    ‘শরীয়ত উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে অনেক আহকামের ভিত্তি বানিয়েছে। তন্মধ্যে সুস্পষ্ট আহকাম হল নামাযের সময়। আর সারা পৃথিবীতে রোযা ও ঈদের ঐক্য জায়েয নয়।

     

    ৪. মূসা রূহানী (১৪১৯হি.= ১৯৯৮ঈ.)

    শায়খুল হাদীস ও শায়খুত তাফসীর হওয়ার সাথে সাথে প্রাচীন ও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বড় পারদর্শী ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর চল্লিশের কাছাকাছি ছোট-বড় কিতাব রচনা করেছেন। তিনি তার ‘সায়রুল কামার ওয়া ঈদুল ফিতর’ কিতাবে নিজ নিজ এলাকার হিলাল দেখার বিধানকেই সমর্থন করেছেন আর পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন যে, শরীয়তের বিধানের ভিত্তি শরয়ী দলীল, বিজ্ঞানের গবেষণা নয়। তিনি এটাও সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, সৌদিআরবের ঈদ থেকে উপমহাদেশের ঈদ পরে হওয়াতে আশ্চর্যের কিছু নেই। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকেও নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও নয়।

     

    ৫. ডক্টর ইউসুফ মুরওয়া

    Jackson university of Mississippi থেকে নিউকিøয়ার ফিজিক্সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করা ছাড়াও বৃটেন, জার্মানি ও আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে নিউকিøয়ার ফিজিক্সসহ সাইন্সের আরো কিছু বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারী এবং বিজ্ঞানের জগতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী প্রতিষ্ঠানالجمعية اللبنانية للأبحاث العلمية -এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ড. ইউসুফ মুরওয়া একই দিনে রোযা ও ঈদের মতবাদের পর্যালোচনা ঐ সময়ের আকাবির ওলামা মাশায়েখের খেদমতে পেশ করেছেন। তাতে তিনি লিখেছেনÑ

    ‘যেহেতু মুসলিম বিশ্ব মাশাআল্লাহ বেশ বড় সীমানা জুড়ে বিস্তৃত। ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত, ১৪২ ডিগ্রি পূর্ব থেকে ১৮ ডিগ্রি পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই ভৌগোলিকভাবে ইসলামী বিশ্বকে তিনটি জোনে ভাগ করা চাই।

    ১. ৩০ ডিগ্রি পূর্ব থেকে ২০ ডিগ্রি পশ্চিম পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্র রয়েছে যথা লিবিয়া তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, মৌরতানিয়া, মালী, চাঁদ, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, বেনীন, ঘানা ইত্যাদি।

    ২. ৩০ ডিগ্রি পূর্ব এবং ৮০ ডিগ্রি পূর্বের মধ্যবর্তী রাষ্ট্রগুলো। যথা মিশর, সুদান, সোমালিয়া, সৌদিআরব, ইয়েমেন, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত  ইরান, তুরস্ক পশ্চিম আফগানিস্তান, পাকিস্তান…।

    ৩. ৮০ ডিগ্রি পূর্ব এবং ১৪০ ডিগ্রি পূর্বের মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহ। যথা বাংলাদেশ, বার্মা, থাইল্যান্ড, চীন মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া।

    তিনি লিখেছেন, এই হল তিনটি জোন। এবার কোনো এক জোনে নতুন চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অবশ্যই অবশ্যই অন্য দুই জোনেও তা দর্শনযোগ্য হয়েছে।

    তার এই লেখা মাজাল্লাতু মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী, সংখ্যা : ২, খ- : ২, পৃষ্ঠা : ৮৮৭-৮৯০-এ প্রকাশিত হয়েছে। আলোচনাটি তার কিতাব ‘আলউলূমুত তাবয়িয়্যাহ ফীল কুরআনে’ও যুক্ত আছে। (পৃ. ১১-১২)

    ৬. জামালুদ্দীন আব্দুর রাযযাক

    الجمعية المغربية لعلم الفلك-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জামালুদ্দীন আব্দুর রাযযাকের কিতাব التقويم القمري الإسلامي الموحد (একক ইসলামী চান্দ্র ক্যালেন্ডার) ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর রাবাত থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি পরিষ্কার লিখেছেনÑ

    لا سبيل إلى التوحيد إذا اعتمدنا رؤية الهلال، حتى مع إقرار الموقف الثالث.

    لا سبيل إلى التوحيد إذا اشترطنا أن ساعة الدخول في الشهر، في بلد ما، تأتي بعد إثبات إمكان الرؤية، في مكان ما من العالم، حتى مع إقرار الحساب وإقرار الموقف الثالث. هذه النقطة من الأهمية بمكان<.

    যদি হিলাল দেখাকেই ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে (রোযা ও ঈদের তারিখের ক্ষেত্রে) ঐক্য সম্ভব নয়। এমনকি যদি এক্ষেত্রে উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মতটিকেই অগ্রগণ্য ধরা হয় তবুও সম্ভব নয়; বরং কোনো শহরে মাস শুরু হওয়ার জন্য যদি এই শর্ত যুক্ত করা হয় যে, পুরো বিশ্বের কোথাও না কোথাও হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতা সৃষ্টি হতে হবে। (অন্যথায় মাস শুরু করা যাবে না) তাহলেও ঐক্য সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবকে ভিত্তি বা উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মতকে গ্রহণ করা হলেও ঐক্য সম্ভব নয়।’ (আততাকবীমুল কামারিল ইসলামিয়্যিল মুওয়াহহিদ’, জামালুদ্দীন আব্দুর রাযযাক, পৃ. ৫)

    এই সুস্পষ্ট বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েও তিনি একক ইসলামিক হিজরী ক্যালেন্ডারের নমুনা পেশ করেছেন। কিন্তু জানা কথা যে, শরীয়তের মানসূস আলাইহি এবং মুজমা আলাইহি বিধান হিলাল দেখার বিধান বাদ দিয়ে এটা গ্রহণ করবে তার বক্তব্য উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল, স্বয়ং বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই শরীয়ত নির্ধারিত ভিত্তি (হিলাল দেখা) বহাল রেখে এবং উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয় মত গ্রহণ করেও বিশ্বব্যাপী ঐক্য অসম্ভব বলেছেন।

     

    ৭. ডক্টর মুহাম্মাদ শওকত ঊদাহ

    International Astronomical Center ICOP -এর প্রধান, জর্দান আলজামইয়্যাতুল ফালাকিয়্যার হিলাল পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধান, ও ‘আলইত্তিহাদুল আরাবী লিউলূমিল ফিযায়ি ওয়াল ফালাক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ডক্টর মুহাম্মাদ শওকত ঊদাহ প্রথমে পুরো পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের জন্য আলাদা আলাদা লুনার ক্যালেন্ডার তৈরী করেছেন। এটা ২০০১ সনের কথা। পরে তিনি পুরো পৃথিবীকে তিন ভাগে ভাগ করে একেক অংশের জন্য আলাদা আলাদা ক্যালেন্ডার তৈরী করেন। পরবর্তীতে তিনি আরো চিন্তা গবেষণার পর চূড়ান্তভাবে আরেকটি লুনার ক্যালেন্ডার তৈরী করেছেন। তাতে পুরো পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক অংশের জন্য একটি করে ক্যালেন্ডার তৈরী করেন। এক অংশে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা। দ্বিতীয় অংশে অন্য সব মহাদেশ। তিনি পরিষ্কার লিখেছেন, হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে যদি লুনার ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা হয়, তাহলে সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমল করা কখনোই সম্ভব হবে না। বিশ্বকে অন্তত দুই ভাগে ভাগ করা জরুরি, তিনি দালীলিক আলোচনা করে তার সিদ্ধান্ত এই ভাষায় পেশ করেছেনÑ

    >ومن هنا برزت الحاجة الضرورية لتقسيم العالم إلى قسمين على الأقل<. (تطبيقات تكنولوجيا المعلومات لإعداد تقويم هجري عالمي، دكتور محمد شوكت عودة، ص ৭-৮)

    উভয় ক্যালেন্ডারে কোনো মাসে তারিখ অভিন্ন আবার কোনো মাসে ভিন্ন। যাই হোক, শওকত ঊদাহ এই ক্যালেন্ডার কোনো মাসআলা হিসেবে পেশ করেননি। তিনি শুধু একটি প্রস্তাব উলামায়ে কেরামের কাছে রেখেছেন।

    তার কাছে আমরা একই দিনে রোযা ও ঈদের প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম যে, কিছু লোক এই মতবাদের দাওয়াত দিচ্ছে, এ বিষয়ে আপনারা কী মনে করেন, তিনি উত্তরে লিখেছেনÑ

    >مسألة هل يصوم الناس معا أو لا يصوموا معا فهي مسألة فقهية يجيب عليها الفقهاء وليس نحن الفلكيون، بالنسبة لنا فنحن مجرد حاسبون، نطوع حساباتنا لما يطلبه ويقره الفقهاء<.

    ‘সমস্ত মানুষ একই তারিখে রোযা রাখবে, না আলাদা আলাদা রাখবে এটা তো ফিকহী মাসআলা। এর জওয়াব তো উলামায়ে কেরাম দেবেন। আমরা তো হিসাব জানি, ব্যস, ফকীহগণ যেভাবে বলবেন, আমরা সেভাবেই হিসাবের খেদমত পেশ করে দেব।’ এটা তিনি আমাদেরকে ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ ঈ.-এর চিঠিতে লেখেন।

    ১৩ই মে ২০১৩ ঈ.-এর পত্রে তিনি এটাও লিখেছেনÑ

    >من الناحية العملية والعلمية لا يمكن توحيد جميع البلاد الإسلامية بناء على رؤية الهلال، فلا يمكن الطلب من سكان أندونسيا وماليزيا والدول الشرقية الانتظار لمعرفة نتيجة تحري الهلال في موريتانيا، ففي هذه الحالة ستشرق الشمس في أندونسيا والناس لا تعرف بعد هل هذا اليوم هو عيد أم لا مثلاً!

    فغاية ما يمكن فعله هو توحيد الدول الإسلامية بناء على تقويم هجري مبني على الحسابات الفلكية، أما التوحيد المبني على الرؤية الفعلية فهذا وهم، ولا يمكن تحقيقه<.

    ‘বাস্তবতার আলোকে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেই হিলাল দেখার ভিত্তিতে মুসলিম বিশ্বব্যাপী তারিখ এক করা সম্ভব নয়। এটা কীভাবে হতে পারে যে, আমরা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য প্রাচ্যের দেশগুলোর উপর বিধান চাপিয়ে দেব যে, তারা যেন মৌরতানিয়ার চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করে। এমন করতে গেলে তো ইন্দোনেশিয়ায় সূর্যোদয় হয়ে যাবে তখনও তারা জানতে পারবে না যে, আজ ঈদ হবে না, রোযাই রাখতে হবে।

    হাঁ, সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা হল, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে প্রণীত একটি হিজরী ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে কেবল মুসলিম বিশ্বে ঐক্য সৃষ্টি করা যেতে পারে। কিন্তু হিলাল দেখার ভিত্তিতে ঐক্য বাস্তবে অসম্ভব। এটা নিছক কল্পনা। একে বাস্তবের রূপ দেওয়া সম্ভব নয়।’

    তো শরীয়ত যখন হিলাল দেখাকেই ভিত্তি বানিয়েছে, আর পৃথিবীর প্রাকৃতিক অবস্থাই এরকম যে, হিলাল দেখার ভিত্তিতে অন্তত ইসলামী বিশ্বেও একই দিনে রোযা ও ঈদ সম্ভব নয়। হাঁ, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবকে ভিত্তি বানালে শুধু বর্তমান মুসলিম বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করার কথা ভাবা যায়। কিন্তু সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা কখনো সম্ভব নয়। তাহলে কোনো মুসলমান এমন আছে যে, শরয়ী ভিত্তি বাদ দিয়ে একই তারিখে রোযা ও ঈদ করতে যাবে? আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত অনুসরণ উদ্দেশ্য নাকি দিলের খাহেশ পুরা করা?

    ডক্টর মুহাম্মদ শওকত ঊদাহ এই বিষয়টি তার প্রবন্ধ ‘আলহিলাল বাইনাল হিসাবাতিল ফালাকিয়্যাতি ওয়ার রুইয়াতি’তেও লিখেছেন। তিনি বলেছেন কোনো স্থানের হিলাল দেখা গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য ধর্তব্য হবে কি না এর ফায়সালা উলামায়ে কেরাম করবেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ নয়।

    তিনি আরো লিখেন, হিজরী মাসের সূচনা কীভাবে হবে এটা শরীয়তের মাসআলা। এর ফায়সালা করবেন ফকীহগণ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ নয়। আর জানা কথা যে, এই বিষয়ে ফকীহগণের ইজমা আছে যে, এই বিষয়ে চাঁদ দেখাই ভিত্তি। অন্য কিছু নয়। দেখুন, তার প্রবন্ধ ‘আলহিলাল বাইনাল হিসাবাতিল ফালাকিয়্যাতি ওয়ার রুইয়াতি’, পৃ. ৭, ১১ ও ১৩

    মুহাম্মদ শওকত ঊদাহ একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কোনো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাই তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন যে, কোন্ মাসআলা শরীয়তের সাথে সম্পৃক্ত আর কোনটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর এই বাস্তবতার বিষয়ে সুস্পষ্ট জবানবন্দীর পর আপনি ঐ ভাইদের কথার হাকীকত বুঝতে পারবেন, যারা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে যান যে, আলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান জানে না। তাই তারা লুনার ক্যালেন্ডারের বিরোধিতা করেন। এই জন্যই তারা একই দিনে বিশ্বব্যাপী রোযা ও ঈদ করার বিপক্ষে। নাউযুবিল্লাহিল আযীম।

    এ সকল ভাইয়ের খেদমতে আমরা বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইলিয়াসের একটি কথা পেশ করতে পারি যা তিনি Washington Islamic centre কর্তৃক প্রকাশিত লিফলেটের উপরে মন্তব্য করে বলেছেন। লিফলেটের বক্তব্য ছিলÑ

    “…. Many good Muslim leaders call for the unification of Muslim dates on the basis of astronomical findings, especially now that science has advanced so much as to put man on the face of the moon. ”

    এর উপর মন্তব্য করে ড. ইলিয়াস বলেন,

    “… Statements of this nature are common in private discussions that take place every year especially at the time of Ramadan. also the mass media, especially newspapers, are full of such comments, mostly from those lacking any appropriate background in astronomy and /or in the Islamic aspects  concerned….” (Astronomy of Islamic Calendar, by: Mohammad Ilyas, page- 60, Published by: A.S. NOORDEEN, Kuala Lumpur, Malaysia, First Published in 1997)

    আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন এবং সকল প্রকার প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত রাখুনÑ আমীন।

    وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

     

    [1] জানি না এ সীমানা নির্ধারণের সূত্র কী? অমুসলিম দেশগুলো তো আল্লাহর জমীনেরই অংশ। এগুলোর উপর তাদের দখলদারিত্ব পুরোটাই জোরপূবর্ক। এগুলোকে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে? তাছাড়া মরক্কোকে কেন মুসলিমদেশগুলোর শেষ সীমানা ধরা হল মৌরতানিয়াও তো মুসলিম দেশ। (আবদুল মালেক)

    [2] হানাফী মাযহাবে রমযানের রোযার জন্য সুবহে সাদিকের আগেই নিয়ত করে নেওয়া মুস্তাহাব। আর অন্যান্য মাযহাবে তো এটা রোযা সহীহ হওয়ার জন্য শর্ত। সাহরী করা সুন্নত। রমযানের তারাবী প্রথম রাত্রেও সুন্নাতে মুআক্কাদা। অথচ একই দিনে রোযার এই উদ্ভাবিত পদ্ধতির কারণে এসব আমল হ-য-ব-র-ল হয়ে যায়।

    [3] ৩. ১৫ই জ্বিলহজ্ব ১৩৬৫ হি. মোতাবেক ১০ নভেম্বর ১৯৪৬ খৃ., ‘আলইলম’ পত্রিকার ৫২তম সংখ্যায় এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়-هل يمكن توحيد الأعياد الدينية في الأقطار الإسلامية (মুসলিম বিশ্বে দ্বীনী পর্বসমূহের তারিখের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টি করা সম্ভব?)। তখন শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে আব্দুর রাযযাক (১৯০৬-২০১১ঈ.) যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দ্বীনী ইলম, উভয় শাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তিনি তার কিতাব العذب الزلال في مباحث رؤية الهلال (খ. ১, পৃ. ১৮৯-২০৭)-এ উক্ত প্রবন্ধের বিস্তারিত খ-ন লিখেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, যুগ যুগ ধরে অনুসৃত কর্মপন্থাই সঠিক। এ থেকে সরে আসার কোনো অর্থই হয় না।

    আমাদের জানা নেই, ১৯৪৬ -এর আগেও  কেউ এই ধরনের দাবি করেছেন কি না, কিন্তু আফসোস হল,  সময় যতই যাচ্ছে আবেগ-প্রবণ লোকদের বাড়াবাড়ি বেড়ে চলেছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, শুধু মুসলিম বিশ্বে একই তারিখে রোযা ও ঈদ কর। এখন বলা হচ্ছে, সমগ্র বিশ্বেই একই তারিখে কর! আসলে এটাও অসম্ভব ওটাও অসম্ভব!

    [4] বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করার থিওরিকে এই হাদীসের উদ্দিষ্ট অর্থ বলে সাব্যস্ত করা হাদীসের সুস্পষ্ট বিকৃতি। উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার বিষয়ে এই হাদীস দিয়ে দলীল পেশ করা  যেমন কয়েকজন ফকীহ করেছেন- সেটা একটা সম্ভাবনাপূর্ণ বিষয়। হাদীসের পূর্বাপরের সাথে তা পুরোপুরি মিলে না। এটা হাদীসের স্বাভাবিক মর্মের বাইরের একটি বিষয়। এটাকে হাদীসের সরাসরি উদ্দিষ্ট মর্ম সাব্যস্ত করা আপত্তিজনক। সৌদিআরবের সাবেক সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীমও এই হাদীস থেকে উক্ত বিষয়ে দলীল প্রদানের উত্তর দিয়েছেন। দেখুন, ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলি সামাহাতিশ শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম, খ. ৪, পৃ. ১৫৫, ফতোয়া : ১০৯৫।

    [5] কুরাইব রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণিত হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ। মুহাদ্দিসগণ একে সহীহ বলেছেন এবং এর মাধ্যমে দলীল পেশ করেছেন এবং বড় বড় ফকীহগণও এই হাদীস দিয়ে দলীল দিয়েছেন। এর উপর মাসআলার ভিত্তি রেখেছেন।

    ‘ওমর’ই সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিড়াল

    সম্প্রতি ইন্টারনেটে ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের ‘ওমর’ নামের একটি বিড়াল। মেইন কুনের এই গৃহপালিত প্রাণীটিকেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিড়াল হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম- বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।
    জানা গেছে, ২০১৩ সালে এর মালিক যখন একে বাড়িতে নিয়ে যান তখন অন্যান্য বাচ্চা বিড়ালের মতোই দেখতে ছিলো সে। কিন্তু বর্তমানে পরিমাপ করে দেখা গেছে, ওমর নামের ওই বিড়ালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ সেন্টিমিটার বা ৩ ফুট ১১ ইঞ্চি।
    অবশেষে ইন্টারনেটে ছবি প্রকাশের পর এর মালিক হার্স্ট জানিয়েছেন, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের লোকজন ওমরের পরিমাপ পাঠানোর জন্য তাকে অনুরোধ করেছেন। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিড়ালের রেকর্ডের মালিক পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের ১১৮ সেন্টিমিটার বা ৩ ফুট ১০ দশমিক ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি বিড়ালের।
    হার্স্ট জানিয়েছেন, দুই সপ্তাহ আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওমরের ছবি দেন তিনি। তারপর থেকে শুধু ইনস্টাগ্রামেই এর ছবি ২৭ হাজারবারেরও বেশি শেয়ার হয়েছে। এছাড়া ওমরকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন ও সংবাদপত্রেও খবর প্রচারিত হয়েছে।

    বিএনপি উজ্জীবিত

    ভিশন-২০৩০ রূপকল্প

    বদ্ধ পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে পানিতে যেমন তোলপাড় শুরু হয়; দেশের রাজনীতিতে তেমনি তোলপাড়  সৃষ্টি করেছে বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ রূপকল্প। এ ঘোষণা একদিকে ক্ষমতাসীন দলকে স্নায়ুবিক চাপে ফেলেছে; অন্যদিকে দলের তৃর্ণমূল নেতা ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। মামলা মোকদ্দমা আর হতাশায় নির্জীব হয়ে পড়েছিল কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিএনপির তৃর্ণমূল নের্তৃত্ব। ভিশন ২০৩০ ঘোষণায় ওই নির্জীব নেতারা সজীব দিয়ে উঠছেন। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বিএনপির রাজনীতি। শুধু বিএনপি নয় সর্বমহলে আঢ়মোড়া ভেঙ্গেছে বেগম জিয়া ঘোষিত রুপকল্প। বুদ্ধিজীবী, সুশীল, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং দেশী বিদেশী কূটনীতিকরা ভিশন-২০৩০ মধ্যে  সুস্থধারা এবং ভবিষ্যতের ইতিবাচক রাজনীতি খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ঘুম যেন হারাম হয়ে গেছে। এখন তারা উন্নয়ন, সরকারের সাফল্য এবং কর্মতৎপরতার স্তুতির বদলে ‘আঙ্গুর ফল টক’ প্রবাদের মতোই ভিশন-২০৩০ অন্তঃসারশূন্য প্রমাণে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা ভিশন-২০৩০ বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এর বড় প্রমাণ দলের ‘ভিশন ২০৩০’। গত বুধবার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশের জন্য ভবিষ্যত পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। এতে সবাইকে নিয়ে এক ‘রেইনবো নেশন’ বা রঙধনু জাতি গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ভবিষ্যতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতামূলক নতুন ধারার রাজনীতি, সুনীতি, সুশাসন ও সু-সরকারের প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার করে গণভোট, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লমেন্ট করা যায় কিনা সে ব্যপারে চিন্তাভাবনার ইংগিত দিয়েছেন। যা দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন চিন্তার খোড়াক জুগিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলকে করেছে আতঙ্কিত এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের করেছে উজ্জীবিত।
    দেশবাসীর সামনে রূপকল্প উপস্থাপনের সপ্তাহ না পেরুতেই ‘ভিশন’ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ‘ভিশন ২০৩০’ এর আলোকে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সঙ্কট ও সমাধানে বিএনপির ভাবনা নিয়ে ‘বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনার করেছে। সে সেমিনারে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের চিন্তা চেতনা এবং করণীয় তুলে ধরেছেন। এভাবে প্রতিটি সেক্টর নিয়ে বিএনপি ধারাবাহিক ভাবে সেমিনার নিস্পোজিয়ামের আয়োজন করবে বলে জানা গেছে। বিএনপির ভিশন-২০৩০ রূপকল্পে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, মাথাপিছু আয় ৫ হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত করা, প্রবৃদ্ধি দুই অংকে নেয়া, দেশীয় বিনিয়োগে নানা সুযোগ-সুবিধাসহ ২৫৬টি দফা তুলে ধরছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। বিএনপির নেতারা বলছেন, এখন থেকে বিএনপির রাজনীতি চলবে ভিশনের আলোকেই। বিএনপির এই ভিশন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক, সরকারের স্তবক বুদ্ধিজীবীরা যতোই অন্তঃসারশুন্য প্রমানে মরিয়া হোক না কেন এটা যে দেশের রাজনীতিতে বিএনপির ঘুড়ে দ্বাড়ানোর বার্তা তা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের হতবিহব্বল (নার্ভাসনেস) দেখেই বোঝা যায়। কয়েক মাস আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সেমিনারে বিএনপিকে ফিনিক্স পাখির সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, বিএনপি একদিন ফিনিক্স পাখির মতোই ছাইভষ্ম থেকে ঘুরে দাঁড়াবে। মির্জা ফখরুলের সেদিনের কথা কেউ গুরুত্ব না দিলেও কার্যত দেশের রাজনীতিতে সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন ‘দুই দলের লিখিত রূপকল্প থাকায় নাগরিকেরা তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ পাবেন। সব মানুষ তো আর আওয়ামী লীগের চোখ দিয়ে বিএনপিকে কিংবা বিএনপির চোখ দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিচার করবেন না। তাঁদের নিজেদেরও তো চোখ আছে, আছে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি। প্রত্যেক ফেরিওয়ালাই তার পণ্যের পক্ষে এবং অন্য বিক্রেতার পণ্যের বিপক্ষে প্রচার চালায়’।
    জুলুম নির্যাতন আর মামলা মোকদ্দমায় বিএনপি ছিল ছন্নছাড়া। গত তিন বছরে দেশের ৩০ জেলা ঘুরে এবং বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সেটাই মনে হয়েছে। এমনো চিত্র দেখেছি শুধু টিকে থাকার জন্য বা নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে বা ব্যবসার পার্টনার করে সুসম্পর্ক রক্ষা করে টিকে থাকছেন। হৃদয়ে বিএনপি কথাবার্তায় আওয়ামী লীগার প্রচার করে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন। আবার কেউ কেউ নিজেকে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। ভিশন ২০৩০ ঘোষণার পর দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ওই বিপর্যন্ত নেতারা হঠাৎ করে চাঙ্গা হয়ে উঠছেন। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্রই এই চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। নেতা-নেত্রীদের বক্তব্যেও দৃঢ় মনোবল লক্ষ্যণীয়। কয়েক দিন আগেও যেখানে বিএনপি নেতা-নেত্রীরা দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ছিলেন সেখানে তাদের বেশ দৃঢ় মনোবল দেখা যাচ্ছে। এছাড়া এতদিন নানান কারণে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পিছুটান লক্ষ্য করা গেলেও তারা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছেন। জেলা পর্যায়ে দলীয় সাংগঠনিক কর্মসূচিগুলোতে উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। ‘নির্বাচনে যাবে বিএনপি’ এ বার্তা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী সমর্থকদের মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়েছে। নতুন কমিটি ঘোষণার পর রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি জেলা-বিভাগীয় শহরেও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দলীয় নেতাকর্মীরা। তারা এখন আন্দোলনমুখী হচ্ছেন। কর্মসূচি চাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতারাও কর্মসূচি দেয়ার কথা আকারে ইংগিতে জানাচ্ছেন। বেশ কয়েকজন নেতা জানান, তারা মনে করছেন বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতোই ঘুরে দাঁড়াবে। মাঠের রাজনীতি দিয়েই নব্বইয়ের মতো সাফল্যের পথে হাটবে বিএনপি। ’৮৬ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও বিএনপি যায়নি। ’৮৮ নির্বাচনেও যায়নি। নির্বাচনে না যাওয়ায় আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি সাংগঠনিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারপরও বিএনপি ’৯১ সালের নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে। যে কৌশলে আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিয়ে সকলকে অবাক করে ক্ষমতায় গিয়েছিল বিএনপি; এবারও সে পথেই হাটবে। ঘোষিত ভিশন দলটিতে সে পথে নিয়ে যাবে বলেও নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
    প্রশ্ন হলো বিএনপিকে নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা কেন? কেনই বা হঠাৎ বিএনপির এই পরিবর্তন? এর পেছনে এমন কী মেসেজ থাকতে পারে যার জন্য বিএনপি চাঙ্গা ভাব? কারণ আর কিছু নয়; ভিশন ২০৩০ রূপকল্প । সুচিন্তিত এই রূপকল্পের মাধ্যমে বিএনপি দেশবাসীর সামনে নতুন বিএনপির আবির্ভাব ঘটিয়েছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো যে রূপকল্প দেয় ক্ষমতায় গেলে তার সবগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে না। বিএনপিও হয়তো করবে না। কিন্তু রূপকল্প দিয়ে বিএনপি যে ইতিবাচক রাজনীতির বার্তা দিচ্ছে তা সুস্থধারার রাজনীতির জন্য ইতিবাচক। এতে রাজনীতিতে কিছুটা হলেও গুনগত পরিবর্তন আসবে। বিএনপির জেলা উপজেলা পর্যায়ের নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ ঘোষণা তাদের নতুন করে উজ্জীবিত করেছে। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন কেন্দ্র থেকে যেকোনো কর্মসূচি দেয়া হলে বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে না। প্রশাসনের লোকজনও তাদের দিকে এখন অন্যদৃষ্টিতে তাকাবে। মাঠের কর্মসূচি শুরু হলে নিজেদের মধ্যেকার বিরোধ বহুলাংশে কমে যাবে। বিএনপির তৃর্ণমূলের নেতাকর্মীরা এতটাই চাঙ্গা হচ্ছে যে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করার মতোও মনোবল তৈরি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে বিএনপি ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের নেতা মন্ত্রীদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। এটা কম সাফল্য নয়। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিএনপির ভিশন অনুযায়ী আগামী দিনে রাষ্ট্র পরিচালনায় গেলে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মকান্ডকে যথাযথভাবে সম্মান দেওয়া হবে। এতে প্রশ্ন থেকে যায় বিএনপি আগামী দিনে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জামায়াতের কী হবে? এ বিষয়টি অস্পষ্ট। এই ভিশনে সত্যতা, সঠিকতা, আন্তরিকতা যেমন আছে, তেমনি আছে ভক্তিপ্রবণতা। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিএনপি ঘোষিত ভিশন-২০৩০ দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। দলটি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে। ইতিমধ্যে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন ধারার রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে স্বপ্ন ভিশনে দেখানো হয়েছে তা এখন জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই মূল লক্ষ্য হবে। এটা তারা যতটা সক্রিয়ভাবে করতে পারবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘোষিত ভিশন-২০৩০ দলটির জন্য খুবই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। তবে ঘোষণা করেই বসে থাকলে চলবে না। এটা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে জনমত গঠনে কাজ করতে হবে। শুধু বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরাই নয়; সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বড় অংশ মনে করছেন বিএনপি ঘোষিত ভিশন খুবই সুচিন্তিত। এ ধরনের ভিশনে দলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করবে এটা স্বাভাবিক। পাশাপাশি দেশের শিক্ষিত সমাজ, তরুণ-তরুণী ভোটার বিশেষ করে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫ তারাও উজ্জীবিত হবে। কারণ তারা নীতিবাচক নয় ইতিবাচক রাজনীতি প্রত্যাশা করেন। যা এতোদিন কোনো দলই দিতে পারেনি। কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের ‘জেগে ওঠার সময়’ নামে একটা উপন্যাস রয়েছে। গ্রাম বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের চিত্র নিয়ে রচিত ওই উপন্যাসের মতোই বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির নেতাদের জেগে তোলার লক্ষ্যে  সঠিক সময়ে বদ্ধ পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মতোই রূপকল্প ঘোষণা করেছেন।

    শিশু কাঁদানো প্রদর্শনী!

    জাপানে অন্যরকম এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর। এই প্রদর্শনীর নাম ‘কাঁদানে সুমো’। সুমো কুস্তিগীরদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় শিশুদের। তারা দুই হাতের মধ্যে নিয়ে জোরে জোরে ঝাঁকাতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না শিশুরা উচ্চস্বরে কান্নাকাটি শুরু করে।

    গত রবিবার রাজধানী টোকিওতে হয়ে গেল এ বছরের প্রদর্শনী। এতে কয়েকশ’ শিশুকে কাঁদানো হয়। জাপানিরা বিশ্বাস করে, এর মাধ্যমে শিশুর মঙ্গল হয়। দু’জন কুস্তিগীর একে একে শিশুদের ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কাঁদাতে থাকেন। সন্তানদের এভাবে কাঁদতে দেখে অনেক বাবা-মাও কষ্টে কেঁদে   ফেলেন। কিন্তু তারপরেও তারা সহ্য করে গেছেন সন্তানের জন্য ভালো হবে মনে করে। তাদের ধারনা, এই দিন থেকে সন্তান কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করল, তাদের সহ্যশক্তি বাড়লো এবং অন্যায়ের প্রতি কঠোর মনোভাব তৈরী হলো।

    প্রায় ৪০০ বছর ধরে চলে আসছে এই ব্যক্তিক্রমী চর্চা। -ইউপিআই

    সবচেয়ে বড় কৃত্রিম সূর্য উদ্ভাবন করলো জার্মানরা

    মানুষের প্রয়োজনে বিজ্ঞানীরা কত কিছুই না উদ্ভাবন করেছেন। এবার জার্মানির বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আকৃতির কৃত্রিম সূর্য।
    সূর্যের উপস্থিতি প্রাণী জগতের জন্য অনেক জরুরি। কিন্তু সব দিন একইভাবে পৃথিবীতে সূর্য আলো ও তাপ ছড়ায় না। যে কারণে অনেক সময়ই বাধাগ্রস্ত হতে পারে মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড। যখন পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকে না, তখন সোলার প্যানেল বা সৌর বিদ্যুত্ উত্পাদনকাজ কিভাবে চলবে? যেহেতু সোলার প্যানেলের মূল খাবার আসে সূর্যের আলো থেকে, ফলে পৃথিবীর যেসব দেশে প্রায়ই সূর্যের দেখা মেলে না, তারা রীতিমত বিপদে পড়েন। সেই সংকটের জবাব খুঁজতে গিয়ে জার্মানির বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন কৃত্রিম এক সূর্য, যাকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কৃত্রিম সূর্য।
    বিজ্ঞানীদের এই দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. কাই উইগহার্ট, যিনি জার্মানির ইন্সটিটিউট অব সোলার রিসার্চ এর প্রধান। তিনি বলছেন, ‘‘এই সূর্যের মাধ্যমে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃত্রিম আলো পাবো, যা খুবই প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানির মতো জায়গায়, যেখানে প্রতিদিন সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না এবং আবহাওয়াও খুব একটা ভালো নয়।’’
    কিন্তু কিভাবে কাজ করে এই কৃত্রিম সূর্য?
    ১৪৯টি ফিল্ম প্রজেকশন লাইট একত্রিত করে আলো প্রক্ষেপণ করা হয়। আর সেই সম্মিলিত আলো প্রতিদিন সূর্যের যে রশ্মি পৃথিবীতে আলো ছড়ায় তার থেকে ১০ হাজার গুন বেশি শক্তিশালী। এই আলোর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আগামী দিনের সোলার বা সৌর বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারছেন।

    মাহে রমযান : পারস্পরিক সহযোগিতা বিবেচনা দায়িত্ব ও ছাড়ের কিছু কথা

    অনন্য ইবাদতের মাস রমযান। এ মাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য মাসব্যাপি রোযা পালন করা। মাসের প্রতিটি দিন উপোস করে, সংযমের সঙ্গে কাটানো। এর সঙ্গে উতপ্রোতভাবে জড়িত সাহরী ও ইফতার-রোযার সূচনা ও শেষের খাবার-উপলক্ষ, আছে তারাবীহ। ফরয নামায ও জরুরি অন্যান্য আমলের পাশাপাশি নফল ইবাদত, তেলাওয়াত এবং দান-খায়রাতের সম্পর্কও এ মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এজন্য দ্বীনী প্রয়োজন ও নিয়মসহ স্বভাবজাত ও   বাস্তব নানা কারণে এ মাসটিতে মুসলমানদের জীবনে কিছু ব্যতিক্রমী রুটিন, প্রস্ত্ততি, উপলক্ষ ও প্রবণতা ফুটে ওঠে। এর প্রভাব মুসলিম প্রধান এ দেশটিতে অ-মুসলিমদেরও স্পর্শ করে যায়। এজন্য রমযানের রোযা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত আমল হওয়া সত্ত্বেও এ উপলক্ষে পারস্পরিক নির্ভরতা, সহযোগিতা ও একের প্রতি অন্যের বিবেচনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সামনে চলে আসে। এ বিষয়গুলো আসে     বিভিন্ন দিক থেকে। মনোযোগ, বিবেচনা ও সচেতনতা না দিলে এতে বিভিন্ন ধরনের বিপত্তি ও সংকটের সৃষ্টি হতে পারে ও হয়ে থাকে। মাহে রমযানে প্রাসঙ্গিক ও জরুরি এ বিষয়গুলোর প্রতি তাই সচেতন হওয়া আমাদের প্রত্যেকের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    দুই.

    প্রথমেই চলে আসে মুসলিম রোযাদার পরিবারগুলোর ঘরণী বা নারী সদস্যদের কথা। রমযানে ঘরের প্রয়োজনীয় সম্মিলিত আয়োজনগুলোতে তারাই সবচেয়ে বেশি শ্রম ও সময় দিয়ে থাকেন। সংসারের কঠিন কাজগুলোর পাশাপাশি ইফতার, সাহরী, রাতের খাবারের প্রস্ত্ততিসহ পরিবারের রোযাদার সদস্যদের নানা চাহিদা মেটানোর পেছনে অকাতরে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। আবার তারা রোযাও রাখেন। ফরয, ওয়াজিব, নফল ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার আবশ্যকতা ও আগ্রহ তাদের মাঝেও থাকে। রোযাজনিত অবসাদ ও ক্লান্তিও তারা বোধ করেন। কিন্তু পরিবারের পুরুষ-সদস্যরা অনেক সময়ই পরিবারের নারীদের সামর্থ ও সীমাবদ্ধতার এই দিকটির প্রতি চোখ রাখেন না। চাহিদা অনুযায়ী কিংবা মনমতো কিছু একটার ঘাটতি ঘটে গেলে তারা বিরক্তি বা ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেন না। এটা রমযান ও রোযার সংযমনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। কখনো কখনো এসব ক্ষেত্রে মানসিক জুলুমের ঘটনাও ঘটে যায়-যেটা রমযান-অ-রমযান কোনো অবস্থাতেই অনুমোদিত নয়।

    এজন্য এ বিষয়টির প্রতি পূর্ণ সতর্কতা ও সর্বোচ্চ বিবেচনা বজায় রাখা রোযাদার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিলে সমস্যার মাত্রা কমে যাবে বলে আশা করা যেতে পারে। এক. রমযানে নারীদের ঘরোয়া আয়োজনগত সেবার মূল্যায়ন করা। কারো পক্ষ থেকে উপকৃত হলে মানুষ যেমন তাকে কথায়-আচরণে খুশি করার চেষ্টা করে, রমযানে ঘরের নারীদের প্রতি তেমন সৌজন্য ও সদাচার প্রকাশ করা উচিত। দুই. সাহরী-ইফতার ও অন্য যে কোনো আয়োজন এবং সেবায় কখনো কখনো মন ও রুচিমাফিক কিছু না পেলে সয়ে যাওয়া ও ধৈর্য্য ধরা। এ কারণে ঘরণীর প্রতি কোনো রকম তিক্ত আচরণ করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকা উচিত। তিন. নিজে রোযাদার হয়েও ঘরণী যে শ্রম ও সময় দিচ্ছেন, সেক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করার ব্যবস্থা নেওয়া। এটা প্রত্যক্ষভাবে নিজে হাত লাগিয়েও করা যায়। আবার সহযোগী কাজের মানুষের ব্যবস্থা করেও তার কষ্ট কমানোর উদ্যোগ নেওয়া যায়। সময়, পরিস্থিতি ও সুবিধা অনুযায়ী সহযোগিতার ধরণটা ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে। চার. রমযানে শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া নফল-মুস্তাহাব পর্যায়ের সেবার জন্য নারীদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দেওয়া। যেমন পরিবারের কর্তার মনে হল, আজ কয়েকজনকে দাওয়াত করে ইফতারের বিশেষ মেহমানদারি করবেন। এজন্য তিনি ঘরণীর সুবিধা-অসুবিধা, ক্লান্তি ও আয়োজনের শ্রম-কোনোদিকেই খেয়াল করলেন না। তার সঙ্গে আলোচনা করে আগেই তাকে মানসিকভাবে তৈরি করা সম্ভব হল না। তাকে শুধু জানিয়ে দিলেন, এতজন মেহমান আসছেন, এই এই আয়োজন করতে হবে। মেহমানদারির এ পদ্ধতি ঠিক নয়। রমযানে ইফতার করানো অনেক ছওয়াবের কাজ। এটা স্বতন্ত্র বিষয়। ঘরণীর ওপর চাপিয়ে না দিয়ে আগ্রহ ও উৎসাহের সঙ্গে সেটা করতে উদ্বুদ্ধ করা এটিও স্বতন্ত্র বিষয়। দুটির মাঝে সমন্বয় করেই এ ধরনের পুন্যের উপলক্ষগুলো সমাধা করতে হবে। কিংবা অন্য উপায়ও তো খোলা আছে। বাইরে থেকে ইফতার কিনে এনেও এটা করা যায়। আবার ঘটনা যদি এমন হয় যে, দাওয়াত কিংবা বিশেষ মেহমানদারির কোনো ব্যাপার নেই, মেহমান নিজেই বাসায় চলে এসেছেন, সেক্ষেত্রে পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যেইে সেটি পড়ে যায়। তখন আয়োজন নিয়ে অস্থিরতারও কিছু নেই। যা আছে এবং যতটুকু করা গেল, তাতেই ইফতার করানোর হক আদায় হয়ে যায়।

    ঘরণীর প্রতি, পরিবারের নারী সদস্যদের প্রতি সদাচার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের দাবি। রমযানুল মুবারকে এ দাবির জোর ও প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। সেজন্য রমযানে এ বিষয়টির প্রতি সবার বিশেষ মনোযোগ থাকা দরকার।

    তিন.

    রমযানে রোযা রাখা তো প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষেরই আমল। আর রোযার অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে, শারীরিক অবসাদ ও   ক্লান্তিবোধ। এ জন্য রমযান মাসে গৃহকর্মীদের প্রতি বিশেষভাবে সদয় ও ছাড়ের দৃষ্টি থাকা উচিত পরিবারে কর্তা-কর্ত্রীদের। পরিবারের সামর্থ ও সুবিধাভেদে গৃহকর্মীদেরও থাকতে পারে নানা পর্যায়। কাজের সহযোগী মহিলা, নিরাপত্তাকর্মী, গাড়ি চালক এবং এ রকম আরও অনেকেই। কোনো কোনো পরিবারে গৃহকর্মী মাত্র একজন থাকতে পারেন, কোথাও হয়ত দিনের খন্ড সময়ের জন্য একজন। তারা যদি রোযাদার হন তাহলে তাদের প্রতি গৃহের অভিভাবকদের কিছু দায়িত্ব চলে আসে। সেটি হচ্ছে, কাজেকর্মে তাদের সহযোগিতা করা। অর্থাৎ যে কাজটি সে একা করত, সেটিতে নিজেও হাত লাগানো যায়। এছাড়া রোযা অবস্থায় নির্ধারিত দায়িত্ব থেকে তার সেবা কিছু কম গ্রহণ করেও এটা করা যায়। অর্থাৎ অন্যান্য সময়ের হিসাব ধরে রমযানে তাকে সবটুকু কাজ করতে বাধ্য না করা। রমযানে তার সেবার বিনিময়ে অন্যান্য মাসের তুলনায় পারিশ্রমিকও কিছু বাড়িয়ে দেওয়া যায়। গৃহকর্মীও আল্লাহর বান্দা, তাকদীর ও তাকসীমে রিযিকের কুদরতী সিদ্ধান্তে সে এখন আমার অধীনস্থ-এ অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত রেখে রমযানে তার প্রতি যতটুকু সদয় হওয়া যায়, ততই কল্যাণ। রমযানুল মুবারক ও রোযার প্রতি সম্মানের ছওয়াব এবং অধীনস্থদের প্রতি সদয় ও সদাচারী হওয়ার ছওয়াব হাসিলের সৌভাগ্য এভাবে হাসিল হতে পারে।

    একইভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রমযানে রোযাদার কর্মচারীদের ওপর কাজের চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা যায়। একজন সুস্থ-সবল ও প্রাণচঞ্চল কর্মীর কাছে যতটুকু সময়ে যতটুকু কাজ নেওয়া হয়ে থাকে, রমযানে রোযাদারের জন্য সেক্ষেত্রে রোযাজনিত ক্লান্তিবোধের প্রতি কিছুটা হলেও সদয় হওয়া অত্যন্ত ছওয়াবের কাজ হবে। মানবিক ও ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণ হিসেবেও সেটা গণ্য হবে। এটা অন্যভাবেও করা যায়। কাজের সময়-পরিমাণটাই কমিয়ে দিয়ে তাতে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করানোর ব্যবস্থা করা যায়। এতে রোযাদারের প্রতি সদয় আচরণের সুফল ও বরকত প্রতিষ্ঠানটি অন্যভাবে লাভ করতে পারবে বলেই আশা করা যায়-ইনশাআল্লাহ।

    আমাদের সমাজে অনেক সময় অর্থ-অপচয়, সময়-অপচয় নিয়ে সচেতনতার প্রসঙ্গ উঠিয়ে একশ্রেণীর মানুষ কেবল ধর্মীয় বিষয়গুলো টেনে আনেন। হজ্ব-কুরবানীর অর্থ-খরচ নিয়ে লম্বা কথা বলেন। অফিস চলাকালে নামাযের বিরতি কিংবা রমযানে রোযাজনিত ক্লান্তির কারণে কর্মঘণ্টা ‘নষ্ট’ হওয়ার গল্প ফাঁদেন। এটা মূলত ধর্মীয় জীবন থেকে দূরে সরে থাকার একটি স্বাভাবিক অথচ অবাস্তব প্রবণতা। কারণ এ সমাজে নেতিবাচক কাজে ও গুনাহর খাতে দৈনিক কোটি কোটি টাকার অপচয় হয়। সেটা তারা ভুলে যান। ফাঁকিবাজি, ইউনিয়ন, অপরাজনীতি ইত্যাদি নেতিবাচক কারণে অফিস-আদালত, কলকারখানায় প্রতিদিন কোটি কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। সেদিকে তাদের চোখ যায় না। তাই তাদের ভুলযুক্তির পেছনে না ছুটে ধর্মীয় জরুরি আচরণ-অনুষ্ঠান ও আল্লাহর ইবাদতে কর্মীদের নিমগ্নতার সময়টাকে প্রতিষ্ঠানের জন্য রহমতের কারণ মনে করা উচিত। অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার দিক থেকে দেখলে তেমনটিই ঘটতে দেখা যায়।

    এক্ষেত্রে জরুরি অপর একটি বিষয়ের উল্লেখ খুবই প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে, রমযানে কাজের ক্ষেত্রে কর্মীদের মাঝে ইচ্ছাকৃত কোনো ধরনের ঢিলেমি না থাকা চাই। গৃহকর্মী বলি আর প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মী বলি, নির্ধারিত সময় ও চুক্তিতে পুরো কাজ করার মানসিকতা ও প্রস্ত্ততি নিজেদের মাঝে লালন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের কর্তার দায়িত্ব হচ্ছে রমযানে রোযাদার অধীনস্থদের প্রতি সদয় হওয়া। এটা তার কাজ। কিন্তু কর্মীদের মনে রাখতে হবে, কর্মীদের জন্য এটা অধিকার নয়। তারা তাদের কাজ যথা সময়ে, যথা নিয়মে করার চেষ্টা করবেন। মূলত দু’ দিক থেকে পরস্পরের প্রতি বিবেচনা থাকলে বিষয়টির বিবেচনা ও ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হয়ে যায়।

    চার.

    রমযানের খাবার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় একটি জটিল ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা রমযানুল মুবারকে রোযাদার ভোক্তাদের প্রতি সুবিচার করবেন-এটাই তো ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক সুবিচার ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে পাওয়া যায় না। অথচ এসব ব্যবসায়ী ভাইয়ের অধিকাংশই মুসলিম ও রোযাদার। তারপরও কেন এমন হয়-ভাবলে সবারই মন বিষিয়ে উঠে। এটা কি ব্যবসায়ীদের উপরতলার কয়েকজনের সিন্ডিকেটেই সীমাবদ্ধ, নাকি ‘সুবিধার ভাগ’ নিতে গিয়ে উপর-নিচের সবাই সমান আকাঙ্খী, সাধারণ রোযাদারদের পক্ষে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এটা বের করা কঠিন। কিন্তু ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় জড়িত ব্যবসায়ী সমাজ এখানে রোযাদারদের হা-হুতাশ ও কষ্টের তীরে যে প্রতিমুহূর্তে বিদ্ধ হন-এটা আমরা অনুভব করি। রমযান মাসে রোযাদারদের সঙ্গে ‘চালাকি’ করে ব্যবসা না করলে ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। চোখে দেখা নগদ লাভের বাইরেও লাভ-ক্ষতির অন্য অংক আল্লাহ তাআলার হিসাবে চালু আছে। অনেক সময় সে হিসাব এ দুনিয়াতেও তার দাপট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তাই রমযানে রোযাদারদের ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা ‘বাড়তি’ ও ‘বিশেষ মৌসুমী’ মুনাফার চেষ্টা বন্ধ রাখলে প্রকৃত হিসাবে তারাও লাভবান হবেন। আর রোযাদাররাও স্বস্তি পাবেন। এর ফলে রমযানে রোযাদার ভাইদের বিক্রেতা ও ভোক্তা-দুটি শ্রেণীর মাঝে পরস্পরের হক ও ভ্রাতৃত্বের দাবিও কিছুটা পূরণ হবে।

    রমযানে পারস্পরিক সহযোগিতার সঙ্গে জড়িত এরকম আরো বহু ক্ষেত্র সামনে চলে আসে। চলার পথ, কেনাকাটা, যানবাহনে উঠা-বসা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে অনেক সময়ই পরিস্থিতি এমন হয় যে, কোনো একজনের অনঢ় অবস্থান কিংবা একগুঁয়েমির কারণে জটিলতা তৈরি হয়। এতে অনেকেই ভোগান্তির শিকার হন। এসব ক্ষেত্রে সহনশীলতাই প্রধান অবলম্বন। কেউ হয়তো ভুল করছেন, অপরজন নরম হয়ে, অন্য কেউ কোমলভাবে বুঝিয়ে পরিস্থিতি সহজ করতে উদ্যোগী হলে সবার জন্যই কল্যাণ হয়।

    পাঁচ.

    রমযানুল মুবারকে সব মুসলিমেরই রোযা রাখার কথা। সে হিসেবে রাস্তায় বের হলে রোযাহীন কোনো মানুষের সাক্ষাত পাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা এরকম নয। রমযানে প্রথম পাঁচ-সাত দিনের পরই রাস্তাঘাটে দেখা যায় রোযাহীন মানুষের উৎকট খাবার-দাবারের আয়োজন। কিছুদিন আগেও এ দৃশ্যটা কেবল ঢাকা শহরের কিছু কিছু জায়গায় সীমিত ছিল। এখন মফস্বলের ছোট শহরগুলোতেও এ জাতীয় লজ্জাহীন খাবার-দাবারের ধুম চোখে পড়ে। রমযানে দিনের বেলায় খানাপিনার এই প্রকাশ্য ও আধা-প্রকাশ্য ব্যবস্থা বা মহড়া শুধু মারাত্মক গুনাহর কাজই নয়, চরম অমানবিক ও বর্বরতাতুল্য কাজ।

    আলোচনার জন্য ধরে নিতে পারি এদেশে অ-মুসলিম যারা আছেন তারা তো আর রোযা রাখেন না। তাদের প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ-নারীরা বাসার বাইরে এলে বা পথে থাকলে তাদের তো কোথাও না কোথাও খেতে হয়। একই সঙ্গে এ তর্কও ওঠানো যায় যে, মুসলমানদেরও তো অনেকে মুসাফির থাকতে পারেন, কেউ কেউ রোযা না রাখার মতো অসুস্থতায় আক্রান্তও থাকতে পারেন। তারাও তো কোথাও না কোথাও খাবেন। এসব তর্ক আসলে শুধুই তর্ক। এগুলো যুক্তির সীমানার মধ্যে পড়ে না। এই তর্কের বাইরে গিয়ে একথাও বলা যায় যে, বহু লোক তো কোনো কারণ ছাড়াও রোযাহীন থাকতে পারেন, এটাও তো তার অধিকার (!) তাই তারও তো খেতে হবে। হ্যাঁ, আল্লাহ তাকে খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ দিয়েছেন, পেটে ক্ষুধা দিয়েছেন, আল্লাহর বিধান দিয়েছেন রোযা রাখার। কিন্তু এর জন্য আল্লাহ কোনো কুদরতি চাপ প্রয়োগ করেন না। বান্দা পয়সার জোরে, সুস্থতার জোরে নিজের ক্ষমতা দিয়ে জাহির করেছেন, তিনি রোযাহীন থাকতে পারেন। তিনি তা করেছেন। তার ফল অবশ্যই তিনি ভোগ করবেন।

    অমুসলিম, অসুস্থ, মুসাফির কিংবা অকারণ রোযাহীন যে-ই হোন, তার রোযা না রাখাটাকে হাজার হাজার রোযাদারের সামনে জাহির করার কী আছে! রাস্তার পাশে প্রকাশ্যে খেতে থাকা, হোটেলগুলো প্রকাশ্যে খুলে রাখা, বিড়ি-সিগারেট, চা-পান প্রকাশ্যে চালিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন! এটা হচ্ছে স্বভাবজাত নির্লজ্জতার পরিচায়ক একটি আচরণ। ইচ্ছা করে মাহে রমযানের অবমাননা, সচেতনভাবে রোযাদারদের কষ্ট দেওয়া ও অসম্মান করার মহড়া এটি।

    বাংলাদেশের মতো দেশে রমযান মাসে প্রকাশ্যে যারা খানাপিনা করেন, তারা কেবল ক্ষুধা মেটানোর জন্য এমন করেন না। এর সঙ্গে অত্যন্ত নীচুমানের জীঘাংসা ও ছোটলোকী মেজাজ জড়িত। তাই যারা না বুঝে অন্যের দেখাদেখি এমন করছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, যে কোনো কারণেই হোক রমযান মাসে নিজে রোযা রাখতে না পারলেও রমযানুল মুবারক ও সিংহভাগ মানুষ -রোযাদারদের প্রতি সম্মান দেখান। এতে হতে পারে, একদিন আল্লাহ তাআলা আপনাকে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দেবেন। আর যারা বুঝেশুনেই এমন করছেন তাদেরকে শুধু বলতে পারি, সামর্থ আর স্বাস্থ্যের জোরে রোযার দিনে প্রকাশ্যে উদরপূর্তির এই ‘ফুটানি’ আল্লাহ তাআলা সহ্য করেন না। এমন দিন তাদের না আসুক যে, টাকা থাকবে, খাবার থাকবে, ক্ষুধা থাকবে, খাওয়ার তীব্র আগ্রহও থাকবে, কিন্তু কিছুই খেতে পারছেন না এবং এভাবেই বছরের পর বছর ‘হর রোজ রোযা’ রেখে পার করতে হবে।

    ছয়.

    এ পর্যায়ে দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম কর্মকর্তাদের বিবেচনার জন্য একটি বিষয় আলোচনা হওয়া দরকার। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে শালীনতা-অশালীনতা প্রশ্নে বেশির ভাগ গণমাধ্যমের উপস্থাপন সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। তারপরও মুবারক রমযান মাসে এ ক্ষেত্রে তাদের উপস্থাপন ও পরিবেশনা একটা সংযমী অবয়ব ধারণ করতে পারে। এটা রমযান মাসের দাবি। এটা রোযাদারদের সংযম চেতনার দাবি। দাবি করেই বলা যায়, রমযানে গণমাধ্যমগুলো অপেক্ষাকৃত সংযমী পরিবেশনা রাখলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বৈ কমবে না। জরুরি খবরাখবর জানতে গিয়ে, দেশ-বিদেশের অবস্থা দেখতে গিয়ে কবীরা গুনাহর হাতছানির মধ্যে পড়ে যাওয়াটা রোযাদারের জন্য চরম ক্ষতিকারক ও অস্বস্তিকর। রোযাদারও তো মানুষ। রমযানের সংযমের মাঝেও তার পেছনে রিপুর প্ররোচনা চলতে থাকে। সেখানে তার চেষ্টা ও প্রয়োজন থাকে রিপুর ওপর জয়ের। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো যদি রিপুর সহায়ক শক্তি হয়ে রোযাদারের সংযমের দূর্গে আঘাত করতে থাকে, সেটাতো সমীচীন কাজ হয় না। রিপুর সহযোগী না হয়ে শুদ্ধ সংযমী আত্মার সহায়ক শক্তি হিসেবে গণমাধ্যমগুলো ভূমিকা রাখুক। অন্তত রমযান মাসে। রমযান মাসে কোটি রোযাদারের এমন একটি নির্দোষ প্রত্যাশার মূল্য দিলে গণমাধ্যমের কর্তারাও কল্যাণের ভাগিদার হবেন বলে আমরা আশা করতে পারি।

    মাহে রমযানের পবিত্রতার সঙ্গে নানা প্রয়োজনে প্রকাশ্যে বিচরণশীল নারীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম নারীকে পর্দা করে চলার নির্দেশ দিয়েছে। আবরণের মধ্যে নিজেকে ঢেকে চলতে নারীদের ওপর ইসলাম ফরয করে দিয়েছে। এটা সব সময়ের জন্য, বাইরে বের হলে নারীর এভাবেই চলা উচিত। কিন্তু যারা এ নির্দেশটা পালন করেন না, এদেশে তাদের একটি অংশ অ-মুসলিম হলেও বড় অংশটি আসলে মুসলিম। আল্লাহর হুকুমের প্রতি অবাধ্যতার এই আমলটি সেই মুসলিম বোনেরা অন্তত রমযান মাসে যদি বন্ধ রাখতে শুরু করেন তাহলে তাদের সামনে কল্যাণের দরজা খুলে যেতে পারে। মনে রাখার বিষয় হচ্ছে, নারীর পর্দাহীনতা শুধু নারীর নিজের একটি করণীয় আমল পরিহারের বিষয় নয়, এর সঙ্গে পুরুষেরও চোখ ও অন্তরের আমল নষ্ট হওয়ার বিষয় জড়িত। পর্দা না করার গুনাহটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হলে এক ব্যাপার ছিল। কিন্তু এটি তো সংক্রামক একটি গুনাহ। পর্দা না করে যারা আরেকটু খোলামেলা কিংবা টাইটফিট পোশাক পরে বাইরে বের হন তাতে তাদের কোনো মঙ্গল না হলেও স্বভাবগত কারণেই বহু পুরুষের ক্ষতি হয়ে যায়। এজন্য উগ্র-বেপর্দা নারীদের প্রতি অনুরোধ, আপনাদের গুনাহময় নিজস্ব লাইফ-স্টাইলের মাধ্যমে অন্যদের রমযানের সংযমে চিড় ধরানো থেকে বিরত থাকা আপনাদের দায়িত্ব। নিজের ধ্বংস নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা না থাকলেও (হয়তো সেটা আপনার অধিকার (!)) অপরের ক্ষতি তো আপনি করতে পারেন না। রমযান মাসে লজ্জাশীলতার পরিচয় দিয়ে একটু সদয় হয়ে রাস্তায় বের হলে বহু রোযাদার পুরুষের ‘জানটা’ বেঁচে যায়।

    সাত.

    রমযান মাসে রোযার প্রাণ ও আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের   বিভিন্ন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা। তারা উদ্যোগী ও তৎপর হলে রমযানের সংযমী পরিবেশ গড়ে তোলা সহজ ব্যাপার। রমযানের বিভিন্ন জরুরি আনুষ্ঠানিকতাগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ। উপরে আলোচিত বেশ কয়েকটি বিষয়ে রাষ্ট্র তৎপর হলে সমস্যাগুলোর সমাধান আপনা থেকেই হয়ে যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্র দিন দিন যতই খোলাসা হচ্ছে ততই এসব ক্ষেত্রে তার অমনোযোগ ও উন্নাসিকতা বেড়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় এবং ধর্ম সংশ্লিষ্ট জরুরি নৈতিকতার ক্ষেত্রগুলোতে রাষ্ট্রকে ইদানীং দূরবর্তী দর্শকের ভূমিকাতেই বেশি দেখা যাচ্ছে। তারপরও নাগরিক সুবিধা-অসুবিধার অতি সাধারণ ও অতি প্রয়োজনীয় বিবেচনা থেকে কয়েকটি বিষয়ে রমযানে রাষ্ট্রের মনোযোগী ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।

    এর একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন কম, ঘাটতি প্রচুর। এগুলো পুরনো কথা। এর জন্য বর্তমান সরকার বহু হাঁকডাক করেও গত আড়াই বছরে কেন কিছু করতে পারেনি-সে তর্কেও যেতে চাই না। রমযানে লোডশেডিং-এর মাত্রাটা যেন কম থাকে শুধু এটুকুই নাগরিকদের এখনকার দাবি। বিশেষত সাহরী, ইফতার ও তারাবীহর সময়ে দু’ ঘণ্টা করে মোট ছয় ঘণ্টা সময় যেন দেশের কোথাও লোডশেডিং না হয়-এ বিষয়টি নিশ্চিত করা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। এর সঙ্গে যুক্ত হবে যোহর ও আসরের নামাযের সময় আরো দু ঘণ্টা। গত দুটি বিশ্বকাপে শুধু টিভিতে খেলা দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশজুড়ে নিশি্ছদ্র বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বিদ্যুৎ বিভাগ তার ‘সক্ষমতা’ দেখিয়েছে। রমযানে সে সক্ষমতা না দেখাতে পারলে আগের দেখানো সব সক্ষমতার ভুল অর্থ দাঁড় করিয়ে নিতে বাধ্য হবেন রোযাদার নাগরিকরা।

    অপর দুটি ক্ষেত্র হচ্ছে গ্যাস ও পানি। রমযান মাসে এ দুটি ক্ষেত্রে কোনো সংকট ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে রোযাদারদের সমস্যার অন্ত থাকে না। এ দুটি খাত নিয়ন্ত্রণে যারা ভূমিকা রাখেন, রমযানে তাদের মনোযোগ ও দক্ষ তৎপরতা দেখতে চায় দেশবাসী। যানজট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা যদি এসব বিষয়ে রমযানে তৎপর না থাকেন তাহলে রোযাদাররা ভোগান্তিতে পড়ে যাবেন, বিষয়টা এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে হয় না। জনগণের ক্ষোভ ও বিক্ষোভের ঘটনাও রাষ্ট্র পরিচালকদের দুশ্চিন্তার কারণে পরিণত হতে পারে। এজন্য এসব ক্ষেত্রে মনোযোগদান নিজেদের প্রয়োজনেই তাদের দরকার।

    মাহে রমযানের রোযা ও অন্যান্য ইবাদত-আমলের মধ্য দিয়ে একটি সামগ্রিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। এজন্য রমযান ও রোযার বিষয়টিকে যার যার ব্যক্তিগত ধর্মপালনের পর্যায়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এর জন্য ব্যক্তির পর সমাজ, সমাজের পর রাষ্ট্রের পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতাকে সবারই গুরুত্বের চোখে দেখা উচিত। এটি কেবল এদেশীয় প্রেক্ষাপটের বিষয় নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের সবকটি দেশেই এ মাসের চিত্রে একটি উজ্জ্বল ভিন্নতা ফুটে ওঠে। অমুসলিম-প্রধান দেশগুলোতেও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে রমযানের পবিত্রতা ও জরুরি আনুষ্ঠানিকতা রক্ষায় জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। তাহলে আমরা কেন সচেতন হব না? নিজেদের পরিমন্ডলে সহযোগিতা, সদয়তা ও ছাড়ের মধ্য দিয়ে সুন্দর ও কামিয়াব রমযান কাটানোর চেষ্টা আমাদের করা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের কবুল করুন।

    সেন্ট্রাল কোরিয়ান নিউজ এজেন্সি’র হুমকি
    যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে হরহামেশা হুমকি দিয়ে আসলেও উত্তর কোরিয়া চীনের বিরুদ্ধে শক্ত কথা বলার নজির নেই বললেই চলে। কিন্তু এবার সরসারি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মুখ থেকে উচ্চারিত না হলেও হুমকি এসেছে তাদের রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা সেন্ট্রাল কোরিয়ান নিউজ এজেন্সি (কেসিএনএ) থেকে। সংবাদসংস্থাটি উত্তর কোরিয়ার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। কেসিএনএর এক মতামতে বলা হয়েছে, নিজের নিরাপত্তার জন্য উত্তর কোরিয়ার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত চীনের। সতর্ক করে বলা হয়েছে, চীন যদি আবার তাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়, তাহলে ভয়াবহ ফল ভোগ করতে হবে। উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র ও প্রধান কূটনৈতিক সমর্থক চীনকে এমন হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর চীনা গণমাধ্যমে এর জবাব দেওয়া হয়েছে। দেশটির গেøাবাল টাইমস পত্রিকায় বলা হয়েছে, পরমাণু অস্ত্রধর উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কিছু ভ্রান্ত যুক্তির ফাঁদে পড়েছে। কোরীয় যুদ্ধের সময় থেকে উত্তর কোরিয়া ও চীনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে। ব্যবসা ও সহযোগিতা সব দিক থেকে দেশটির প্রধান বন্ধু চীন। স¤প্রতি তাদের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন হামলার হুমকি দিচ্ছে, তখনও চীন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তাদের সাহায্য করে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরমাণু কার্যক্রম নিয়েই উত্তর কোরিয়ার ওপর পুরোপুরি খুশি নয় চীনও। দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন পাঁচ বছর হলো ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু এখনো বেইজিং সফর করেননি তিনি।

    শবে বরাত : কিছু ভ্রান্তি নিরসন

    আলকাউসারের শাবান ১৪২৬ হি. (সেপ্টেম্বর ’০৫ ঈ.) সংখ্যায় ‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবে বরাত’ শিরোনামে, শাবান ১৪২৭ হি. (সেপ্টেম্বর ’০৬ ঈ.) সংখ্যায় ‘উলামায়ে সালাফের উক্তির আলোকে শাবান শবে বরাত’ শিরোনামে এবং রজব ১৪২৮ হি. (আগষ্ট ’০৭ ঈ.) সংখ্যায় ‘অজ্ঞতা ও রসম-রেওয়াজের কবলে শাবান-শবে বরাত : নববী নিদের্শনাই মুক্তির উপায়’ শিরোনামে শাবান ও শবে বরাত সম্পর্কে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় কথা পাঠকের সামনে এসে গেছে। ওয়াল হামদু লিল্লাহি তাআলা আলা যালিকা হামদান কাছীরা।

    এ সংখ্যায় শুধু কিছু ভুল ধারণা চিহ্নিত করে দিতে চাই। কেননা এগুলো সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন এসে থাকে।

    প্রশ্ন ১ : আমি এক কিতাবে পড়েছি যে, শবে বরাত বিষয়ক সকল হাদীস ‘মওযু’। ইবনে দিহয়ার উদ্ধৃতিতে কথাটা ওই কিতাবে লেখা হয়েছে।

    উত্তর : এটা একটা ভুল কথা। ইবনে দিহয়া কখনো এমন কথা বলতে পারেন না। যিনি তার উদ্ধৃতিতে এ কথা লিখেছেন তিনি ভুল লিখেছেন। ইবনে দিহয়া শুধু এটুকু বলেছেন যে, শবে বরাতে বিশেষ নিয়মের নামায এবং সে নামাযের বিশেষ ফযীলতের যে কথাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত, তা মওযু। তাঁর মূল আরবী বক্তব্য তুলে দিচ্ছি :

    أحاديث صلاة البراءة موضوعة

    ‘শবে বরাতের বিশেষ নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো মওজু।’

    (তাযকিরাতুল মওজুআত, মুহাম্মাদ তাহের পাটনী পৃ. ৪৫)

    আল্লামা লাখনৌবী রাহ. ‘আল আছারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ’ (পৃ. ৮০-৮৫)তে পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘শবে বরাতে রাত্রি জেগে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল যাতে আগ্রহ বোধ হয় তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ যত রাকাআত ইচ্ছা নামায পড়তে পারে, তবে এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরনের কথা পাওয়া যায় সেগুলো ‘মওযু।’ তবে এ রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী এবং এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করা মুস্তাহাব-এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত। মোটকথা, এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা যেমন ভুল তদ্রূপ মনগড়া কথাবার্তায় বিশ্বাসী হওয়াও ভুল।’

    আল্লামা শাওকানীও ‘আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ’ পৃ. ৫১)তে এই ভুল ধারণা সংশোধন করেছেন।

    প্রশ্ন ২ : একজন আলিমের কাছে শুনেছি যে, শবে বরাতে কবরস্থানে যাওয়া ‘মাসনূন’ নয়। আর আজকাল যেভাবে এ রাতে কবরস্থানে মেলা বসানো হয় এবং মহিলারাও বেপর্দা হয়ে সেখানে গিয়ে ভিড় করে, তা তো একেবারেই নাজায়েয।

    প্রশ্ন এই যে, যতটুকু নাজায়েয তা তো অবশ্যই নাজায়েয, কিন্তু যদি মহিলারা বেপর্দা না হয় এবং কোনো গুনাহর কাজও সেখানে না হয় তবুও কি এ রাতে কবর যিয়ারত মাসনূন বলা যাবে না? হাকীমুল উম্মত ‘ইসলাহুর রুছূম’ কিতাবে একে ‘মাসনূন’ লিখেছেন।

    উত্তর : মহিলাদের জন্য যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরস্থানে যাওয়া এমনিতেও নিষেধ। এরপর যদি পর্দাহীনতা ও অন্যান্য আপত্তিকর বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত হয় তবে তা আরো কঠিন হয়ে যায়। আর কবরস্থান যদি নিকটবর্তী হয় এবং মাযার না হয় আর সেখানে শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কাজকর্ম না হয় তাহলে পুরুষের জন্য এ রাতে সেখানে গিয়ে যিয়ারত করার বিধান কী? হাকীমুল উম্মত রাহ. প্রথমে একে মাসনূন লিখেছিলেন। পরে আরো চিন্তা-ভাবনা ও উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মত বিনিময় করার পর ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেন এবং লেখেন যে, আমি কবরস্থানে যাওয়া থেকে বারণ করাকেই অধিক সতর্কতার বিষয় মনে করি। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৮) শরীয়তের নীতিমালার আলোকে হযরত থানভী রাহ-এর দ্বিতীয় মতই অগ্রগণ্য।

    প্রশ্ন ৩ : সুনানে ইবনে মাজাহ-তে (হাদীস নং : ১৩৮৮) পনেরো শা‘বান রাত সম্পর্কে এই হাদীসটি উল্লেখিত হয়েছে :

    قوموا ليلها وصوموا نهارها

    এই রাত জেগে ইবাদত কর এবং দিনে (অর্থাৎ পনেরো শা’বান) রোযা রাখ।

    এই হাদীসটি থানভী রাহ. ‘খুতবাতুল আহকাম’-এ উল্লেখ করেছেন এবং ‘ইসলাহুর রুসূম’-এ পনেরো শাবান-এর রোযাকে মাসনূন বলেছেন। কিন্তু এক ব্যক্তি আমাকে বলেছেন যে, শায়খ আলবানী এই হাদীসটিকে মওযু বলেছেন। এরপর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ তকী উছমানী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘ইসলাহী খুতবাত’-এ দেখলাম যে, সেখানে এই হাদীসটিকে ‘জয়ীফ’ লেখা হয়েছে এবং এই রোযাকে ‘সুন্নত’ মনে করা ভুল বলা হয়েছে। প্রকৃত বিষয়টি বুঝে আসছে না। আশা করি সাহায্য করবেন।

    উত্তর : ইবনে মাজাহর উপরোক্ত হাদীসটি ‘মওজু’ তো কখনোই নয়। তবে সনদের দিক থেকে ‘জয়ীফ’। যেহেতু ফাযাইলের ক্ষেত্রে ‘জয়ীফ’ গ্রহণযোগ্য তাই আলিমগণ শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে এ হাদীস বয়ান করে থাকেন।

     

    শায়খ আলবানী ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’ (৫/১৫৪) তে এই বর্ণনাকে ‘মওজূউস সনদ’ লিখেছেন। অর্থাৎ এর ‘সনদ’ মওজূ। যেহেতু অন্যান্য ‘সহীহ’ বর্ণনা উপরোক্ত বর্ণনার বক্তব্যকে সমর্থন করে সম্ভবত এজন্যই শায়খ আলবানী সরাসরি ‘মওজূ’ না বলে ‘মওজূউস সনদ’ বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। তথাপি শায়খ আলবানীর এই ধারণা ঠিক নয়। সঠিক কথা এই যে, এই বর্ণনা ‘মওজূ’ নয়, শুধু ‘জয়ীফ’। ইবনে রজব রাহ. প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের এই মতই আলবানী সাহেব নিজেও বর্ণনা করেছেন।

    এ প্রসঙ্গে আলবানী সাহেব যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা এই যে, এ বর্ণনার সনদে ‘ইবনে আবী ছাবুরা’ নামক একজন রাবী রয়েছেন। তার সম্পর্কে হাদীস জাল করার অভিযোগ রয়েছে। অতএব এই বর্ণনা ‘মওজু’ হওয়া উচিত। তবে এই ধারণা এ জন্য সঠিক নয় যে, ইবনে আবী সাবুরাহ সম্পর্কে উপরোক্ত অভিযোগ ঠিক নয়। তার সম্পর্কে খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, জয়ীফ রাবীদের মতো তার স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা ছিল। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা যাহাবী রাহ. পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণেই তাকে জয়ীফ বলা হয়েছে।’ দেখুন সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/২৫০

    সারকথা এই যে, উপরোক্ত বর্ণনা মওজু নয়, শুধু জয়ীফ।

    পনেরো শাবানের রোযা সম্পর্কে থানভী রাহ. যে ‘মাসনূন’ বলেছেন তার অর্থ হল মুস্তাহাব। আর ইসলাহী খুতবাতের আলোচনা মনোযোগ দিয়ে পড়া হলে দেখা যায় যে, তা এ কথার বিপরীত নয়। ওই আলোচনায় ‘জয়ীফ’ হাদীসের ওপর আমল করার পন্থা বিষয়ে একটি ইলমী আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। হযরত মাওলানা পনেরো তারিখের রোযা রাখতে নিষেধ করেননি। তিনি শুধু এটুকু বলেছেন যে, একে শবে বরাতের রোযা বলবে না। গোটা শাবান মাসেই শুধু শেষের দুই দিন ছাড়া, রোযা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া প্রতিমাসের ‘আয়্যামে বীজ’ (চাঁদের ১৩,১৪,১৫ তারিখ) রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিনের রোযা রাখা হলে ইনশাআল্লাহ ছওয়াব পাওয়া যাবে।

     

    প্রশ্ন ৪ : আমি একটি পুস্তিকায় পড়েছি যে, শবে বরাত সম্পর্কে যেসব রেওয়ায়েত পাওয়া যায় তন্মধ্যে সনদের বিবেচনায় সবচেয়ে উত্তম রেওয়ায়েতটিই হল ‘জয়ীফ।’ তাহলে অন্যগুলোর অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়। এ কথা কি সঠিক?

    উত্তর : এ কথাটা একেবারেই ভুল। শবে বরাত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস এসেছে। তার মধ্যে একটি হাদীস ‘সহীহ’, কিছু হাদীস ‘হাসান’ আর কিছু ‘জয়ীফ’। এ জন্য শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস জয়ীফ-একথা ঠিক নয়। সনদের বিচারে সবচেয়ে উত্তম বর্ণনা সেটা যা ইবনে হিববান ‘কিতাবুস সহীহ’ তে (হাদীস ৫৬৬৫) বর্ণনা করেছেন।

    عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن.

    হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।’

    আরো একাধিক হাদীসে এ বিষয়টি এসেছে। যেগুলোর সনদ ‘হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী।’ যথা মুসনাদে আহমদ এর ৬৬৪২ নং হাদীস, এবং মুসনাদুল বাযযার (২০৪৫)-এ আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত হাদীস।

    এছাড়া এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়।

    হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন-

    هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم.

    ‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩৮২-৩৮৩

     

    ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-

    هذا مرسل جيد

    এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।

    এধরনের বেশ কয়েকটি সহীহ ও হাসান হাদীস বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কি এ কথা বলা উচিত যে, এ বিষয়ে সর্বোত্তম হাদীসটি সনদের বিচারে জয়ীফ? ভালোভাবে না জেনে কথা বলা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিরাপদ রাখুন।

    প্রশ্ন ৫ : লোকেরা বলে, এ রাতের ফযীলত শবে কদরের সমান। কুরআন মজীদে ‘লায়লাতিন মুবারাকা’ বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে। এ কথাটা কি সঠিক?

    উত্তর : দুটো কথাই ভুল। শবে বরাতকে শবে কদরের সমান মনে করা ভুল। কুরআন-হাদীসে শবে কদরের যত ফযীলত এসেছে শবে বরাত সম্পর্কে আসেনি। বিশেষত কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার মতো বরকতময় ঘটনা শবে কদরেই সংঘটিত হয়েছে। এই ফযীলত অন্য কোনো রজনীতে নেই।

    ‘লায়লাতিন মুবারাকা’ বলে শবে কদরকেই বোঝানো হয়েছে, যা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সূরা কদরে। এজন্য এখানে শবে বরাত উদ্দেশ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

    আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক অবস্থানে দৃঢ়পদ থাকার তাওফীক দান করুন। ইমাম ইবনে রজব রাহ. এর ভাষায় : ‘মুমিনের কর্তব্য এই যে, এ রাতে খালেস দিলে তওবা করে যিকির, দুআ ও ইস্তেগফারের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামায পড়বে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যানের মওসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেওয়া কর্তব্য। আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ছওয়াব লাভের আশা নিয়ে পনেরো তারিখের রোযাও রাখবে। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল, ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দুআ কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা : শিরক, হত্যা, হিংসা-বিদ্বেষ। এগুলো সবগুলোই কবীরা গুনাহ। আর হিংসা-বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

    যেকোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ প্রবণতা। তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন সম্পর্কে অন্তরে হিংসা ও বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত ভয়াবহ ও গর্হিত অপরাধ। এজন্য মুসলমানদের কর্তব্য হল সর্বদা   অন্তরকে পরিষ্কার রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পাক-পবিত্র রাখা। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরী ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফিরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ -লাতাইফুল মাআরিফ পৃ. ১৫৫-১৫৬#

    ভাবনা সবার নির্বাচন
    বদলে যাচ্ছে দেশ; বদলে যাচ্ছে রাজনীতির চালচিত্র। জুলুম-নির্যাতন ও সংঘাত-সংঘর্ষের বদলে বাতাসে ভাসছে নির্বাচনের গন্ধ। মাঠের বিরোধী দলকে ঠেঙ্গানোর বদলে নিজেরাই ভোটের প্রস্তুতিতে ঘর গোছানোর পাশাপাশি ইসলামী চিন্তাচেতনার ভোটারদের ভোট নৌকায় উঠানোর চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিও পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোটের দৌড়ে সামিল হতে এরশাদ জোট গঠনের ঘোষণা দিলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ কার্যত নিষ্প্রভ। তার মতোই নিষ্প্রভ বর্তমান সংসদের দেড় শতাধিক এমপি। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে তারা সংসদে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন না করার ঘোষণায় আগামী ভোটে সে ধরনের সম্ভাবনা দেখছেন না। ‘এমপিত্বের আমলনামা’ খারাপ হওয়ায় সারাদেশের শোয়া শ’ থেকে দেড়শ এমপির দলীয় নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সভা সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সে ইংগিত দিচ্ছেন। নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে তাদের মধ্যে ততই বাড়ছে হতাশা। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, বর্তমান সংসদ কোনো ক্রিয়াকর্ম করছে না। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের যে দায়িত্ব তারা সেটা না করায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জরুরী হয়ে পড়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুনসেফ আলী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের প্রস্তুতির সময়ই ইসির উচিত নেবেল প্লেইং ফিন্ড গঠনে মনোযোগ দেয়া। যদিও পুরোপুরি সেটা সম্ভব নয়; তারপরও চেস্টা করতেই হবে। পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, পাকিস্তানী কায়দায় ‘কম গণতন্ত্র অধিক উন্নয়ন’ থিউরি দিয়ে আমলাদের হাতে গণতন্ত্রের দায়িত্ব দেয়ায় ফেয়ার নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ক্ষমতাসীনরা সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে দেবে এটা বিশ্বাস করা দুস্কর।
    আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে তিনি সবাইকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ‘আমি কখনওই চাইব না আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠুক’। তিনি দিল্লী থেকে প্রকাশিত ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আর কোনও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন চাই না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কার্যত নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যাচ্ছেন জনগণের কাছে নৌকায় ভোট চাচ্ছেন। নানা দাবি উালেও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী এবং বিশিষ্টজনেরাও গণতন্ত্র বাঁচাতে নির্বাচন ‘অত্যাবশ্যক’ মনে করছেন। তারা বলছেন নির্বাচনকালীণ সরকার কেমন হয় তার উপর সবকিছু নির্ভর করছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। বড় দুই দলের সিনিয়র নেতারা তৃর্ণমূল সফরে গিয়ে নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতি, প্রার্থী নির্বাচন এবং দলের ‘বিতর্কিত’ নেতাদের সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। তবে কিছু কিছু নেতা এবং বড় বড় পদধারী নির্বাচন ইস্যুতে অনেকটা উদাস। ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেয়া এসব এমপি জনগণের মুখোমুখি হবেন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারবেন এমন আস্থা পাচ্ছেন না।
    গণতান্ত্রিক দেশ এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচন জাতিসংঘ, ওআইসিসহ প্রভাবশালী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছে এখনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রভাবশারী দেশগুলোর নেতাদের ঢাকা সফর এবং ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের কথাবার্তায় তার প্রকাশ ঘটছে। দেশের সাধারণ মানুষ ভোটের অধিকার হারিয়ে চাপা ক্ষোভে ফুঁসছে। বিশ্বপরিমন্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন জরুরী। সে জন্যই আওয়ামী লীগ চায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী এবং বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে। যার কারণে রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ ইসলামী ধারার সংগঠন হেফাজতের ভোটের দিকে হাত বাড়িয়েছে। দলটি প্রচার করছে এটা রাজনৈতিক কৌশল। অন্যদিকে নানা বিতর্কের মধ্যেও বিএনপি নানা কারণে পর্যুদস্ত জামায়াতকে ছাড়ছে না। ভোটের প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগের নেতা এবং মন্ত্রীরা জেলা সফলে যাচ্ছেন এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলের অভ্যন্তরে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দিয়ে বিতর্কিত নেতাদের বার্তা দিচ্ছেন আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হওয়া না হওয়া নিয়ে। অন্যদিকে বিএনপির তৃর্ণমূলে ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে সাংগঠনিক পুনর্গঠন, থিঙ্কট্যাংকের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং কূটনীতিসহ সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনার মাধ্যমে দলীয় কৌশল প্রণয়ন করছে। জেলা পর্যায়ে সংগঠনিক কর্মকান্ড দেখভালের লক্ষ্যে অর্ধশতাধিক কমিটি গঠন করেছে দলটি। ওই কমিটিগুলো সাংগঠনিক পুনর্গঠনে কাজ করছে। এসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের তত্ত¡াবধানে। বিএনপির দায়িত্বশীল সুত্রের মতে ‘নির্বাচনী সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি অব্যাহত রাখলেও যে কোনো প্রক্রিয়ায় হোক আগামী ভোটে দলটি অংশ নেবেই। গতকালও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার এবং নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে বিএনপি নির্বাচনের জন্য সব সময় প্রস্তুত। বিএনপিকে নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল হিসেবে অবিহিত করে তিনি বলেছেন, ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে বিএনপির ৯০০ প্রার্থী আছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ৭ মে জোটের ঘোষণা দেয়া হবে। তবে ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুশোচনায় এরশাদ বলেছেন, জাতীয় পার্টি কার্যত পরিচিতি ক্রাইসিসে ভুগছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এরশাদ নিজের নের্তৃত্বে জোট গঠনের তৎপর হলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ কার্যত হতাশ। তিনি নির্বাচনী এলাকার জনগণ দূরের কথা দলের নেতাকর্মীরাই তার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
    নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি প্রসঙ্গে ন্যাপ ঐক্য প্রক্রিয়ার আহবায়ক পঙ্কজ ভট্টচার্য ইনকিলাবকে বলেন, দুনিয়াতে সবচেয়ে অভিনব তত্ত¡ কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ্যের নের্তৃত্বের দাবিদার আওয়ামী লীগ এখন ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’ থিউরি প্রচার করছে। ’৭১ এর আগে পাকিস্তান শাসকরা এটাই চাইতেন। যেখাবে গণতন্ত্রের জন্য দেশ স্বাধীন করলাম, সেখানে কম গণতন্ত্র প্রচারণায় আতঙ্কিত হই। পাকিস্তানের শাসকরা গণতন্ত্রের রশি টেনে ধরে আমলাদের হাতে দেয়। নির্বাচনের আওয়াজ শুনছি কিন্তু নির্বাচনকালীণ সরকার কেমন হয় সেটার ওপর নির্ভর করছে গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচনকালীণ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থাকলেও ভোটের তিন মাস আগে ও পরে প্রশাসনের মৌলিক বিষয়ে হাত দেবেন না। ফেয়ার ভোট চাইলে ইসির কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো ইনকিলাবকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালে নির্বাচন হতেই হবে। মানুষ চায় ফেয়ার এন্ড ফ্রি ইলেকশন। আওয়ামী লীগ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে যা করছে তাতে তারা ফেয়ার নির্বাচন দেবে বিশ্বাস করা কঠিন। ওই সময় তো সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, একটি পৌরসভা এভাবে না জিতলে সমস্যা ছিল না। কাজেই নির্বাচনী আমেজ আছে কিন্তু আগাম কিছু বলা দুস্কর। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুনসেফ আলী ইনকিলাবকে বলেন, বিএনপির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যেভাবে প্রচারণা চালাতে পারবেন বিএনপি হয়তো সে ভাবে পারবে না। তাদের অনেকেই মামলার কারণে নির্বাচনও করতে পারবেন না। তবে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থেই। বর্তমানে বড় দুই দল নির্বাচনী প্রচারণায় নামলেও ‘নিরপেক্ষ ভোট’ হবে কিনা তা নিয়ে স্বংশ্বয় রয়ে গেছে।

    মার্কিন জ্বালানীবাহী জাহাজের নিরাপত্তায় জাপানের রণতরী প্রেরণ

    বিতর্কিত সামরিক আইন পাসের পর মার্কিন জ্বালানীবাহী জাহাজের নিরাপত্তায় এই প্রথম সবচেয়ে বড় রণতরী পাঠালো জাপান। কোরীয় উপসাগরে প্রেরিত মার্কিন নৌবহরের (কার্ল ভিনসন) জ্বালানীবাহী একটি জাহাজকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারবাহী ‘ইজুমো’কে প্রেরণ করা হয়েছে।
    এর আগে, ক্রমবর্ধমান উত্তর কোরিয়-মার্কিন উত্তেজনার মধ্যে কার্ল ভিনসনকে ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ডুবিয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দেন কিম জং উন। এমনকি গত রবিবার ফের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় নিভৃতাকামী কমিউনিস্ট দেশ উত্তর কোরিয়া। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশ উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কার্যকলাপ থামাতে বাববার সতর্কবানী দিয়ে আসছে।
    জাপান টাইমস জানাচ্ছে, প্রায় আড়াইশো  মিটার লম্বা ‘ইজুমো’ নয়টি পর্যন্ত হেলিকপ্টার বহনে সক্ষম এবং এটিকে মার্কিনীদের উভচর হামলায় ব্যবহৃত রণতরীর মতো শক্তিশালী বলে ধারণা করা হচ্ছে।
    সংবাদসংস্থা কিয়োদো আরো জানাচ্ছে, জাপানের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল শিকোকুতে মার্কিন ওই জাহাজটিকে পাহারা দিতে টোকিওর দক্ষিণের বন্দর থেকে যাত্রা করেছে ইজুমো।

    মহান মে দিবস

    Posted by admin on May 2
    Posted in Uncategorized 

    মহান মে দিবস

    আজ মহান মে দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে দিবসটি পালিত-উদযাপিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে অনুষ্ঠিত শ্রমিক সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে ১০ জনের বেশি শ্রমিক নিহত হয়, আহত হয় অনেকে। শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে কয়েকজন পুলিশও নিহত হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়। প্রহসনমূলক বিচারে কয়েকজন শ্রমিক নেতার ফাঁসি হয়। শ্রমিক আন্দোলনের এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের স্মরণে ১লা মেকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয় পরবর্তীকালে। সেই থেকে সারাবিশ্বে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। এত বছরেও শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার, সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বলা যাবে না যদিও অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থার গুণগত পরিবর্তন ও উন্নতি হয়েছে। মে দিবস শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। তা একই সঙ্গে শ্রমিকদের কাছে বিজয়, আনন্দ, প্রতিজ্ঞা ও অনুপ্রেরণার উৎস। স্বীকার করতেই হবে, দীর্ঘ ও ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মানবিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে, শোষণ-বঞ্চনা কমেছে। অবশ্য এখনো কম মজুরি, মজুরিবৈষম্য, নিয়মিত মজুরিপ্রাপ্তি, শ্রমক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ইত্যাদির সমস্যা রয়েছে। এ কারণে শ্রমিক অসন্তোষও আছে। আছে আন্দোলন, সংগ্রাম। আসলে শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যায়সঙ্গত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির দাবি ও আন্দোলন একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারো অজানা নেই, শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থা এবং শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক এখন আর সেই উনিশ শতকের অবস্থায় নেই। অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বস্ততপক্ষে শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক ছাড়া উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কোনো সহজ উপায় নেই। এ জন্য উভয় পক্ষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য।
    শিল্প-কারখানার সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক ওতপ্রোত। শ্রমিক ছাড়া উৎপাদন হতে পারে না। শ্রমিকদের শ্রম যেমন উৎপাদনের নিয়ামক তেমনি এই শ্রম তাদের আয়- রোজগারেরও উপায়। মালিকরা শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে মুনাফা ও আয় উপার্জনের জন্য। কিন্তু শ্রমিক ছাড়া কারখানা অচল। শ্রমিক-মালিক স্ব-স্ব স্বার্থে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। কারখানা আছে, শ্রমিক নেই কিংবা শ্রমিক আছে কারখানা নেই, এটা কল্পনাও করা যায় না। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক যত মধুর ও দৃঢ় থাকবে, উভয় পক্ষের লাভ ও সুবিধা ততই বেশি হবে। শিল্প-কারখানায় পুরোদমে উৎপাদন চালু থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ে, সচল থাকে। অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়ে। অর্থনীতি গতিশীলতা লাভ করে। উৎপাদন ও অর্থনীতিতে সচলতা থাকলে, উন্নতি হলে তখন মালিকদের দায়িত্ব বর্তায় শ্রমিকদের মজুরি ও ভাতা বাড়ানো, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার। মালিকরা শ্রমিকদের দেখবে, শ্রমিকরা দেখবে মালিকদের, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের মূল কথা এটাই। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, মানবিক সুযোগ-সুবিধা, কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকদের দায়িত্ব। শ্রমিকদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে, সততার সঙ্গে শ্রম দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখা।
    আমাদের দেশে, স্বীকার করতেই হবে, নানা কারণে উৎপাদন ব্যবস্থা ও শিল্প-কারখানার অবস্থা ততটা ভালো নয়। নানাবিধ সমস্যা-সঙ্কট এখানে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ বন্ধত্ব, গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, অবকাঠামো সুবিধার অপ্রতুলতা, যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে উৎপাদন ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। যে গার্মেন্ট শিল্প আমাদের শিল্প সেক্টর, উৎপাদন ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান ও রফতানিতে বিপ্লব এনেছে সেই গার্মেন্ট শিল্পের অবস্থাও এখন শোচনীয়। নানা কারণে বহু গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াও বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ওদিকে শ্রমিকদের মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দান এবং কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত ও নিরাপদ করার বিষয়ে যে আলোচনা-বিতর্ক ছিল তা অবসানে ইতিবাচক অগ্রগতি হলেও সব কিছুর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, বলা যাবে না। শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়া হয়েছে। এমনকি ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজও চলছে। এই অগ্রগতিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। উৎপাদন ব্যবস্থা আরো গতিশীল হলে, উৎপাদন, রফতানি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে আমরা নিশ্চিত, মালিক-শ্রমিকরা লাভবান হব, অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাবে। অতএব, উৎপাদন, শিল্পায়নে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে,  সস্তা শ্রমের দিন শেষ। এটা মাথায় রেখেই উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। মালিক-শ্রমিক সরকার একজোট হয়েই সবকিছু করতে হবে।

    পাপ-পুণ্যের ধারা

    দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের কর্মক্ষেত্র। এই কর্ম যাতে সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া যায়, সেজন্য মানুষকে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ, শক্তি-সামর্থ্য ও দিকনির্দেশনা দান করা হয়েছে। এসব কাজে লাগিয়ে একজন মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি-ধন্য হতে পারে। দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানকে জ্যোতির্ময় করতে পারে। গড়ে তুলতে পারে নেক ও সওয়াবের প্রভূত সঞ্চয়।

    এ প্রচেষ্টার সর্বশেষ সীমা হল মৃত্যু। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সমাপ্তি ঘটে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সকল সম্পর্ক। নিঃশেষ হয়ে যায় যাবতীয় কর্মক্ষমতা। না ভালো কাজের শক্তি থাকে, না মন্দ কাজের। না সওয়াব উপার্জনের সক্ষমতা থাকে, না গোনাহ কামানোর।

    মৃত্যুর পর শুরু হওয়া জীবনের প্রথম মনযিল হল কবর। কবরের জীবনের পর সকলকে আল্লাহ তাআলার কাছে সমবেত হতে হবে। তিনি পার্থিব জীবনের হিসাব-নিকাশ নিবেন এবং ভালো-মন্দ যাবতীয় কর্মের প্রতিদান দিবেন। তখন কারো ঠিকানা হবে জান্নাত, কারো জাহান্নাম।

    সেদিন নেককার ও গোনাহগার উভয়েরই নিজ নিজ কৃতকর্ম স্মরণ হবে। নেককার আফসোস করবে কেন আরো বেশি নেক অর্জন করেনি। আর গোনাহগারের অনুতাপ তো হবে অন্তহীন- কেন গোনাহ থেকে বেঁচে থাকেনি। কেউ কেউ তাদেরকে আবার দুনিয়াতে পাঠানোর আবেদন করবে। কিন্তু এ কি সম্ভব?

    বুদ্ধিমানের কর্তব্য গোনাহ থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকা। আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির পথে অগ্রগামী হওয়া এবং মৃত্যুর আগেই মৃত্যু ও তার পরের জীবনের যথোচিত প্রস্তুতি নেওয়া।

    আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে তাঁর প্রিয় মুমিনদেরকে এ কথাই স্মরণ করিয়েছেন-

    وَ اَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنِیْۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیْبٍ فَاَصَّدَّقَ وَ اَكُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ وَ لَنْ یُّؤَخِّرَ اللهُ نَفْسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُهَا  وَ اللهُ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ .

    আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারো মৃত্যু এসে যাবে আর তখন সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। যখন কারো নির্ধারিত কাল এসে যাবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দিবেন না। আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত। -সূরা মুনাফিকূন (৬৩) : ১০-১১

    হাদীসে বুদ্ধিমানের পরিচয় এভাবে ব্যক্ত হয়েছে-

    الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا، وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.

    বুদ্ধিমান সে-ই যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করে। আর অক্ষম সে-ই যে নিজের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলে এবং আল্লাহর কাছে (বৃথা) আশা পোষণ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯

    চতুর্থ খলীফা আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর একটি বক্তব্যে দুনিয়া-আখেরাতের স্বরূপ ও আমাদের করণীয় এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

    إِنَّ الدُّنْيَا قَدْ تَرَحَّلَتْ مُدْبِرَةً، وَإِنَّ الْآخِرَةَ مُقْبِلَةٌ وَلِكُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا بَنُونَ، فَكُونُوا مِنْ أَبْنَاءِ الْآخِرَةِ، فَإِنَّ الْيَوْمَ عَمَلٌ وَلَا حِسَابَ، وَغَدًا حِسَابٌ وَلَا عَمَلَ.

    দুনিয়া ফিরে যাচ্ছে আর আখেরাত এগিয়ে আসছে। আর এ দুটির প্রত্যেকটিরই আছে সন্তানাদি। তোমরা আখেরাতের সন্তান হও। কারণ আজ শুধু আমল, হিসাব নেই। আর আগামীকাল শুধু হিসাব, আমল নেই। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৩৫৬৩৬

    আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক বিশেষ নিআমত হল, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমলের ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট কিছু আমল করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব জারি থাকে। অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের জন্য সওয়াব পৌঁছার ব্যবস্থা করে যেতে পারে এবং চাইলে অন্য কেউও তাকে সওয়াব পৌঁছাতে পারে। এ উভয় পদ্ধতিই আল্লাহ তাআলার একান্তই দয়া ও অনুগ্রহ। নতুবা বান্দার কি সাধ্য ছিল কর্মক্ষমতা হারানোর পরও প্রতিদান লাভের? প্রথম পদ্ধতিটির নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই। আলোচনার সহজতার জন্য একে ‘সওয়াব লাভের উপায়’ বলা যেতে পারে। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ‘ঈসালে সওয়াব’ নামে অধিক পরিচিত। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে প্রথম পদ্ধতিটি (সওয়াব লাভের উপায়) সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা উপকারী বলে মনে হচ্ছে।

     

    সওয়াব লাভের উপায়

    সঠিক পদ্ধতি ও সহীহ নিয়তে করা মুমিনের কোনো নেক আমলই বৃথা যায় না। আল্লাহ তাআলার কাছে এর বিনিময় সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু মৃত্যুর পর যেহেতু কোনো আমল করা সম্ভব নয় তাই সওয়াব ‘কামাই করা’ও অসম্ভব। তবে এমন কিছু আমল আছে, যা জীবদ্দশায় করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব ও উপকারিতার ধারা অব্যাহত থাকে । যথা-

    এক. সদকায়ে জারিয়া

    সদকামাত্রই উপকারী ও বিরাট সওয়াবের কাজ। এর বহু প্রকার ও ধরন রয়েছে। কিছু সদকা আছে অস্থায়ী। যেমন কাউকে খাদ্যদ্রব্য দান করা। আর কিছু সদকা আছে স্থায়ী। যেমন মসজিদ নির্মাণ করা। এই প্রকার সদকাকে ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলা হয়। সদকায়ে জারিয়া করলে মৃত্যুর পরও দানকারীর ‘সওয়াব-সঞ্চয়’ সমৃদ্ধ হতে থাকবে। এর ¯্রােতধারা তার ‘পুণ্য-তরি’কে চলমান রাখবে।

    এখানে সদকায়ে জারিয়ার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি :

    ১. মসজিদ নির্মাণ।

    ২. মকতব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা।

    ৩. দ্বীনী পাঠাগার ও দ্বীনী কিতাবের ব্যবস্থা করা।

    ৪. ঈদগাহ বানানো।

    ৫. কবরস্থান করা।

    ৬. যে কোনো দ্বীনী কাজের জন্য জমি ওয়াফ্ক করা।

    ৭. এতীম ও অসহায় লোকদের বাসস্থান ও উপার্জনের ব্যবস্থা করা।

    ৮. রাস্তা ও পুল নির্মাণ করা।

    ৯. পানির ব্যবস্থা করা।

    ১০. ফলদার বৃক্ষ রোপণ করা।

    ১১. সরাইখানা তৈরি করা।

    ১২. সীমান্ত পাহারা দেওয়া ইত্যাদি।

    দুই. উপকারী ইলম

    উপকারী ইলম অর্জনের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। এর উপকারিতা হাসিল করতে পারে প্রথমত ব্যক্তি নিজেই। সেই সাথে যদি এর প্রচার-প্রসার করা হয়, মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া হয়, যা দ্বারা তারা যুগ-যুগ ধরে উপকৃত হতে থাকবে, কল্যাণ ও শান্তির পথে এগুতে থাকবে এবং যার ধারাবাহিকতা ব্যক্তির মৃত্যুর পরও চলমান থাকবে, তবে তা আরো বেশি মহিমময়। যতদিন এই ইলম দুনিয়াতে আলো ছড়াতে থাকবে ততদিন তার সওয়াবের ভুবনও আলোকিত হতে থাকবে।

    তিন. নেক সন্তানসন্তান-সন্ততি আল্লাহ তাআলার এক মহা মূল্যবান নিআমত। এ শুধু পার্থিব অবলম্বনই নয়; আখেরাতের সম্বলও বটে। নিজের দুনিয়া ও আখেরাতকে সুন্দর করার পক্ষে বড় সহায়ক। সততা-যোগ্যতা ও তাকওয়া-তহারাতের উপর তাকে প্রতিষ্ঠিত করলে মা-বাবা দুনিয়া-আখেরাত সবখানে উপকৃত হবেন এবং মৃত্যুর পরও এই বৃক্ষের সুফল ভোগ করতে থাকবেন।

    উপরোক্ত তিনটি বিষয় হাদীসে এভাবে ব্যক্ত হয়েছে-

    إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ.

    মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার তিনটি আমল ছাড়া সমস্ত আমল তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে- সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম, যা থেকে উপকৃত হওয়া যায় এবং নেক সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৩১০

    আরেকটি হাদীসে এসেছে, ‘মানুষ যা কিছু রেখে যায় তার মধ্যে তিনটি জিনিস উত্তম- নেক সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে। এমন সদকা যা অব্যাহত থাকে। এর সওয়াব সে লাভ করে। এবং এমন ইলম, যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৪৯৫

    এ তিনটি কাজ পৃথক পৃথকভাবেও বর্ণিত হয়েছে। উপকারী ইলম সম্পর্কে ‘সুনানে ইবনে মাজাহ’র (২৪০) একটি বর্ণনা এ রকম-

    مَنْ عَلَّمَ عِلْمًا فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِه، لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ.

    যে কাউকে ইলম শিক্ষা দেয়, সে এ অনুযায়ী আমলকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। আমলকারীর সওয়াব থেকে কমানো হবে না।

    অন্য এক হাদীসে এসেছে-

    أَفْضَلُ الصَّدَقَةِ أَنْ يَتَعَلَّمَ الْمَرْءُ الْمُسْلِمُ عِلْمًا ثُمَّ يُعَلِّمَهُ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ.

    উত্তম সদকা হল নিজে ইলম শিক্ষা করা এবং অপর মুসলিম ভাইকে তা শিক্ষা দেওয়া। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৩

    নেক সন্তান সম্বন্ধে এক হাদীসের ইরশাদ-

    إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَرْفَعُ الدَّرَجَةَ لِلْعَبْدِ الصَّالِحِ فِي الْجَنَّةِ، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ، أَنَّى لِي هَذِهِ؟ فَيَقُولُ: بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ.

    আল্লাহ তাআলা জান্নাতে নেককারের মর্যাদা উঁচু করলে সে জিজ্ঞেস করবে, হে আমার প্রতিপালক! এটা আমার জন্য কোথা থেকে এল? তিনি বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তিগফারের কারণে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০৬১০

    চার. নেক কাজের সূচনা

    নেক কাজের সূচনা করা যথেষ্ট কঠিন। সূচনাকারীকে কত বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়! কত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়! এসব কিছু পেছনে ফেলে একটি নেক কাজের ভিত্তি স্থাপন করলে পরবর্তী সময়ে যারা ঐ কাজ করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ সওয়াব সে পাবে।

    জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আলবাজালী রা.  থেকে বর্ণিত, একবার কিছু বেদুঈন কম্বল পরিহিত অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এল। তিনি তাদের দুরবস্থা দেখলেন। তারা ভীষণ অভাবগ্রস্ত ছিল। উপস্থিত লোকদেরকে তিনি তাদের জন্য দান করার প্রতি উৎসাহিত করলেন। কিন্তু এ কাজে তারা কিছুটা দেরি করল। এতে নবীজীর চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ পর এক আনসারী একটি রূপার থলি নিয়ে এল। কিছুক্ষণ পর আরেকজন এল। এভাবে একে একে সকলেই দান করলেন। তখন নবীজীর চেহারায় প্রসন্নতা ফুটে উঠল। তিনি ইরশাদ করলেন-

    مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً، فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ، كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا، وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ، وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً، فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ، كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا، وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ.

    যে ইসলামে কোনো উত্তম নিয়ম চালু করে, যে অনুযায়ী পরবর্তীতে আমল করা হয়, তার জন্য আমলকারীদের অনুরূপ সওয়াব লেখা হবে। তাদের সওয়াব সামান্য পরিমাণও কমানো হবে না। আর যে ইসলামে কোনো মন্দ নিয়ম চালু করে, যে অনুযায়ী পরবর্তীতে আমল করা হয়, তার জন্য আমলকারীদের অনুরূপ গোনাহ লেখা হবে। তাদের গোনাহ কিছুমাত্রও কমানো হবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৭

    পাঁচ. মৃত সুন্নাহ জীবিত করা

    যে কোনো সুন্নাহ মানুষের কর্ম থেকে বিলুপ্ত হতে থাকলে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর চিন্তা ও বিশ্বাস থেকে হারাতে শুরু করলে তো কথাই নেই। আরো কঠিন হয় যখন সেটার জায়গায় কোনো বিদআত এসে ঢুকে পড়ে। এ জাতীয় মৃত সুন্নাহ পুনরুজ্জীবিত করলে পরবর্তীতে যারা ঐ সুন্নাহর অনুসরণ করবে তাদের সকলের অনুরূপ সওয়াব তার আমলনামায় জমা হবে।

    নবীজীর ইরশাদ-

    مَنْ أَحْيَا سُنَّةً مِنْ سُنَّتِي قَدْ أُمِيتَتْ بَعْدِي، فَإِنَّ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلَ مَنْ عَمِلَ بِهَا…

    যে আমার পরে একটি মৃত সুন্নাহ জীবিত করবে সে পরবর্তীতে যারা এ অনুযায়ী আমল করে, তাদের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। তাদের সওয়াব সামান্য পরিমাণও কমবে না। আর যে এমন কোনো নবআবিষ্কৃত বিষয় উদ্ভাবন করবে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পছন্দ নয়, পরবর্তীতে যারা এ অনুযায়ী আমল করে, তাদের সমপরিমাণ গোনাহ তার উপর বর্তাবে। তবে তাদের গোনাহ বিন্দুপরিমাণও কমবে না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৭

    ছয়. হেদায়েতের দিকে ডাকা

    ইসলামে ব্যক্তিগত সংশোধনে আত্মতৃপ্তি পছন্দনীয় নয়; আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী ও অন্যান্যদের হেদায়েতের ব্যাপারেও আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিজের দ্বীনের সহীহ বুঝ ও সমঝ অর্জন এবং নিজের জীবনে তা বাস্তবায়নের পাশাপাশি মুসলিমের এক দায়িত্ব হল অপরকে এর দিকে ডাকা, তার কাছে ইসলামের কল্যাণকর শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। বস্তুত দাওয়াত হচ্ছে হেদায়েতের নূর সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার এক মূল্যবান উপায়। যারা এই দাওয়াতে সাড়া দেবে তাদের অনুরূপ সওয়াব আহ্বানকারীর সংগৃহীত হবে। তাদের আমলের ধারা যদি তার মৃত্যুর পর পর্যন্ত বহাল থাকে, তাহলে ততদিন পর্যন্তই সে এর সওয়াব পেতে থাকবে।

    হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

    مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ…

    যে মানুষকে হেদায়েতের দিকে ডাকে পরবর্তীতে যারা তা অনুসরণ করে তাদের অনুরূপ সওয়াব তাকে দান করা হবে। তবে ওদের সওয়াব বিন্দুপরিমাণও কমবে না। আর যে গোমরাহীর দিকে ডাকে পরবর্তীতে যারা তা অনুসরণ করে তাদের সমপরিমাণ গোনাহ তাকে বহন করতে হবে। এতে ওদের গোনাহ সামান্য পরিমাণও কমবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস  ২৬৭৪

    সারকথা হল, এ ছয়টি কাজ (সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম, নেক সন্তান, নেক কাজের সূচনা, মৃত সুন্নাহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও হেদায়েতের দিকে ডাকা) করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব লাভ করা যাবে।

    এখানে প্রসঙ্গক্রমে দুটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন মনে হচ্ছে-

    (ক) উপরোক্ত ছয়টি কাজ মৌলিক শিরোনাম মাত্র। প্রত্যেকটির বিস্তর শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এক সদকায়ে জারিয়ারই তো কত প্রকার! উপকারী ইলমের কত অঙ্গন ও অনুষঙ্গ! নেক কাজ ও সুন্নাহ্র কত বৈচিত্র্য ও বিস্তৃতি এবং হেদায়েতের দিকে ডাকার কত পথ ও পন্থা!

    এ ছয়টি কাজের মধ্যে শেষ তিনটি মূলত উপকারী ইলমেরই শাখা। আরও খুলে বললে কুরআন-সুন্নাহ্য় ‘সদকা’ শব্দ যে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই হিসেবে নেক সন্তান ও উপকারী ইলমকেও ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলা যায়। ‘সহীহ ইবনে খুযায়মা’ গ্রন্থে নি¤েœাক্ত শব্দে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে-

    إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِن مِنْ عَمَلِه وَحَسَنَاتِه بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلِمَهُ وَنَشَرَهُ، أَوْ وَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ، أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ، أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ، أَوْ نَهَرًا كَرَاهُ، أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ، تَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ.

    মুমিনের মৃত্যুর পর তার যেসব আমল তার সাথে যুক্ত হয় তা হল- তার শেখানো ও প্রচারিত ইলম। তার রেখে যাওয়া নেক সন্তান। মসজিদ নির্মাণ করা। সরাইখানা তৈরি করা। পানির নহর খনন করা। জীবদ্দশায় সুস্থ অবস্থায় দান-খায়রাত করা। এগুলোর সওয়াব সে মৃত্যুর পরও পায়। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৪৯০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪২

    ইমাম বায়হাকী রাহ. (৪৫৮হি.) এ হাদীসটির সাথে এধরনের আরেকটি হাদীস বর্ণনা করে বলেন-

    ‘এ দুটি বর্ণনার সহীহ হাদীসের (যাতে আছে যে, তিনটি ছাড়া সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়) সাথে বিরোধ নেই। কারণ এতে ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলা হয়েছে, যা এখানের অতিরিক্ত আমলগুলোকে শামিল করে।’ -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/২৪৮

    (খ) এগুলো শুধু সওয়াবের জন্য বিশেষ নয়; গোনাহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ কেউ যদি গোনাহের কাজে ‘গোনাহে জারিয়া’র সূচনা করে, ক্ষতিকর জ্ঞানের প্রচার-প্রসার করে, ছেলে-মেয়েকে অসৎরূপে গড়ে তুলে, খারাপ কাজের সূচনা বা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, মানুষকে গোমরাহীর দিকে ডাকে, তাহলে যতদিন তা বাকি থাকবে ততদিন তার গোনাহের বোঝা ভারি হতে থাকবে। এই অন্ধকার ছড়ানোর ধারা তার মৃত্যুর পরও চলমান থাকলে মৃত্যুর পরও তার আমলনামা অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে থাকবে।

    এ সংক্রান্ত কিছু হাদীস তো পাঠক ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছেন। নিম্নে আরও কিছু আয়াত ও হাদীস পেশ করছি।

    কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

    لِیَحْمِلُوْۤا اَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً یَّوْمَ الْقِیٰمَةِ وَ مِنْ اَوْزَارِ الَّذِیْنَ یُضِلُّوْنَهُمْ بِغَیْرِ عِلْمٍ اَلَا سَآءَ مَا یَزِرُوْنَ.

    কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের (কৃত গোনাহের) পরিপূর্ণ ভারও বহন করবে এবং তাদেরও ভারের একটা অংশ, যাদেরকে তারা অজ্ঞতার কারণে বিপথগামী করছে। -সূরা নাহল (১৬) : ২৫

    অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

    وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالًا مَعَ أَثْقَالِهِمْ.

    তারা নিজেদের গোনাহের বোঝা বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে আরো কিছু বোঝা। -সূরা আনকাবুত (২৯) : ১৩

    নবীজীর ইরশাদ-

    لاَ تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا، إِلَّا كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا، لِأَنَّهُ أَوَّلُ مَنْ سَنَّ القَتْلَ.

    যে কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হবে এর গোনাহের একটা অংশ প্রথম আদম সন্তানের উপর বর্তাবে। কারণ সেই প্রথম হত্যার প্রবর্তন করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭৭

    আর এগুলো গোনাহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া শরীয়তের বিধান ‘একজনের গোনাহের বোঝা আরেকজনের উপর বর্তাবে না’- এর সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ, একজনের গোনাহের ভার আরেকজনের উপর বর্তাবে না; যদি এর সাথে তার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা না থাকে। অন্যথায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকলে তার উপরও এর একাংশ গোনাহ বর্তাবে। বলাই বাহুল্য, এটা অন্যের বোঝা নয়, নিজেরই সংশ্লিষ্টতার বোঝা।

    সূরা নাহলের ২৫ নং আয়াতের তাফসীরে শাইখুল ইসলাম যাকারিয়া আনসারী রাহ. (৯২৬ হি.) বলেন,

    তারা নিজেদের কুফ্র অবলম্বনের বোঝা বহন করবে। সেই সাথে তাদের কারণে যারা বিপথগামী হয়েছে তাদেরও পুরোপুরি বা আংশিক গোনাহ। আর আল্লাহর ইরশাদ-  وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی

    এর অর্থ হল, যেখানে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই- না কারণগত না অন্য কোনোভাবে। -ফাতহুর রহমান পৃ. ৩০৪

    খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহ. (১৩৪৬হি.) من دعا إلى هدى হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেছেন,

    ‘তুমি যদি প্রশ্ন কর, এ তো বাহ্যিকভাবে আল্লাহর ইরশাদ, وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی -এর সাথে সাংঘর্ষিক?

    আমি বলব, উভয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কারণ গোমরাহীর দিকে আহ্বানকারী অনুসরণকারীদের গোনাহ বহন করেনি; বরং তারা যে তার কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে সেটার গোনাহ বহন করেছে।’ -বাযলুল মাজহুদ ১৩/৩৭

    এজন্য গোনাহের ধারা চলমান থাকে এমন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।