করোনা ভাইরাস : বর্তমান সম্পর্কে সচেতন থাকি, সামনের আমলের প্রস্তুতি নিই

আমরা সবাই একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ভীতি ও শঙ্কা সারা বিশ্বকে গ্রাস করেছে। বিশ্বব্যাপী যাতায়াত ব্যবস্থা ও অন্যান্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। কোনো কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘লক-ডাউন’ ঘোষিত হয়েছে। তবে এই সব কিছুর পেছনে খুবই ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস। হাঁ, করোনা ভাইরাস। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকের মৃত্যু ঘটেছে। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মারা যাওয়ার সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে পরিস্থিতি ভয়ের, তবে তার চেয়েও বেশি চিন্তা-ভাবনা ও সচেতনতার। এ পরিস্থিতিতেও উদাসীন-অমনোযোগী থাকা ভালো নয়। আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সচেতন হওয়া মানে কী?

এ ধরনের পরিস্থিতিতে সচেতন হওয়া মানে আল্লাহকে ভয় করা, আল্লাহ-অভিমুখী হওয়া, নিজের কর্ম ও আচরণের মুহাসাবা করা, কর্ম-আচরণে যদি আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতার কোনো কিছু থাকে তাহলে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করা। এটি প্রথম কাজ। এর পাশাপাশি সাধারণ সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করাও কাম্য। এক্ষেত্রে সংক্রমণ এড়াতে যে স্বাভাবিক সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যেমন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সাবান-পানি দিয়ে নিয়মানুযায়ী হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির ক্ষেত্রে সাধারণ শিষ্টাচার মেনে চলা, আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে মেলামেশা এড়িয়ে চলা ইত্যাদি নিয়ম মেনে চলতে কোনো বাধা নেই। এই সাধারণ স্বাস্থ্য-বিধি বা বিশেষ অবস্থায় বিশেষ নিয়মকানুন মেনে চলার শিক্ষা ইসলামী শরীয়তে আছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উপরোক্ত স্বাভাবিক সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি তাকদীরে বিশ্বাস রাখা এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট ও সমর্পিত থাকা। এতেই মুমিনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ। রোগ-ব্যাধি, সুস্থতা-অসুস্থতা, জীবন-মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছায়। তাঁর ইচ্ছাকে রদ করার কেউ নেই। রোগ-ব্যাধির কারণগুলোও তাঁর সৃষ্টি, তাঁরই ইচ্ছায় সেগুলো কাজ করে। মুমিনের কর্তব্য এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে তাঁর ইচ্ছায় পূর্ণ সমর্পিত থাকা যে, আল্লাহ তাআলা যা লিখে রেখেছেন তার অন্যথা কিছুতেই হবে না। সুস্থতা লিখিত থাকলে সুস্থ থাকব, অসুস্থতা লিখিত থাকলে তা-ই ঘটবে। তবে বিষয়টি যেহেতু আমাদের জানা নেই তাই তাকদীরে বিশ্বাসের সাথে স্বাভাবিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাওয়াও ইসলামেরই নির্দেশ। এই অটল বিশ্বাস ও সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে দিন-গুজরানকারী মুমিনের যাই ঘটুক সেটি তার জন্য কল্যাণের হবে। সুস্থতাও কল্যাণের, অসুস্থতাও কল্যাণের, এমনকি মৃত্যু ঘটলে সেটিও হবে কল্যাণের। আল্লাহ তাআলা এই বান্দাকে দান করবেন শাহাদাতের মর্যাদা। কাজেই অতি মাত্রায় ভয়ের কিছু নেই।

মানুষের জীবনে কখনো কখনো এই রকমের অবস্থা ও পরিস্থিতি আসে। মূলত তা পরীক্ষারই নানা রূপ। মুমিনের কর্তব্য, পরিস্থিতি বুঝে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করা।

সচেতনতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে, কোন অবস্থায় কুরআন-সুন্নাহ্র কী বিধান কী শিক্ষা তা সঠিকভাবে জেনে আমলে আনা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কুরআন-সুন্নাহ্র শিক্ষা জানতে হবে হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ নীতির অনুসরণ আমাদেরকে সত্যিকারের কল্যাণের অধিকারী করতে পারে। জীবনের ভালো-মন্দ সব কিছুই আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠতে পারে।

সাময়িক বা তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির বিশেষ করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা ও আমলের পাশাপাশি সাধারণ করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কেও স্বাভাবিক কর্ম-ধারা, যিকির-তিলাওয়াত, সামনের আমলের স্বাভাবিক প্রস্তুতিও কাম্য। আমাদের সবারই জানা আছে যে, মাহে রমযান সমাগতপ্রায়। দেখতে দেখতে রহমত ও মাগফিরাতের এই মাস আমাদের মধ্যে উপস্থিত হবে। এই মাসের ইবাদত-বন্দেগীর জন্য এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা কর্তব্য।

মুমিনের প্রতিটি দিন হতে হবে তার বিগত দিনের চেয়ে ভালো। নিজের ও সংশ্লিষ্টদের জীবন ও কর্মগঠনে প্রতিদিনই তার কিছু কিছু উন্নতি হবে। তার উন্নতির সূচক হবে ঊর্ধ্বমুখী।

দ্বীনী জীবন গঠনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ দ্বীনী ইলম। দ্বীনী ইলম অর্জন করা ছাড়া দ্বীনী জীবন গঠনের ও উন্নতি সাধনের চিন্তা বাতুলতা মাত্র। তাই মুমিন প্রতিদিনই শিখতে থাকবে, জানতে থাকবে। দ্বীন সম্পর্কে, ঈমান সম্পর্কে জানার ধারাবাহিকতায় কখনই ছেদ পড়বে না। হাঁ, ব্যস্ততা-অবসরের পার্থক্যে সময় দেয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য হতে পারে কিন্তু যাকে বলে ‘পাঠ চুকিয়ে ফেলা’Ñ অন্তত দ্বীনী ইলমের ক্ষেত্রে  তো কখনো ঘটবে না।

মাহে রমযান একদিক থেকে কুরআনের মাস। তাই এ মাসে মুমিন বিশেষভাবে কুরআনের বিষয়ে মনোযোগী হতে পারেন। কুরআনের সাথে নিজের ও সংশ্লিষ্টজনদের সম্পর্কের দিকটি মূল্যায়ন করতে পারেন। জীবনের যে দিনগুলো কেটে গেছে সে হিসেবে কুরআন মাজীদের সাথে সম্পর্ক কতটুকু হয়েছে তার হিসাব মেলাতে পারেন। সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন পড়া কতটুকু শেখা হয়েছে, স্ত্রী-সন্তানেরাও শিখেছে কি না, নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস হয়েছে কি না, কুরআন মাজীদের কয়টি সূরা বা কতটুকু অংশ হিফয হয়েছে, পূর্ণ কুরআন মাজীদ হিফয করার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা আছে কি না, কুরআন মাজীদের মৌলিক শিক্ষা হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে স্বচ্ছভাবে জানার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা আছে কি না, কুরআন মাজীদের আদেশ-নিষেধ, করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা কতটুকু তৈরি হয়েছে, নিজের ও সংশ্লিষ্টদের জীবনে তা কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে, কুরআনে কারীমের আকীদা-ব্যবস্থা, ইবাদত-ব্যবস্থা, আখলাক-ব্যবস্থা, লেনদেন-ব্যবস্থা, সামাজিক-ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে জানাশোনার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে কি না, অন্তরে আল্লাহর ভয়, আল্লাহর প্রতি ভরসা, দুনিয়ার মোহমুক্তি, আখিরাতমুখিতা তৈরি হচ্ছে কি না, কুরআনে কারীমের প্রতিশ্রæতি ও হুঁশিয়ারি সম্পর্কে বিশ্বাস ও সংবেদন কতটুকু তৈরি হয়েছে, স্বাভাবিক জীবন-যাত্রায় ও পরস্পরের সম্পর্কে সেই সংবেদনের প্রতিফলন ঘটছে কি না, কুরআনের ইলমের ধারক-বাহকদের প্রতি অন্তরে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও নম্রতা তৈরি হচ্ছে কি না, কুরআনের শিক্ষা-বিস্তারে অংশগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, আখিরাতের জীবনে চলে যাওয়ার পরও পুণ্যের ধারা অবিচ্ছিন্ন রাখতে পারার কোনো চিন্তা ও পরিকল্পনা করা হয়েছে কি না, করে থাকলে হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কেরামের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে স্বচ্ছ-সঠিক রূপরেখা প্রণীত হয়েছে কি নাÑ ইত্যাদি অনেক কিছুই ভেবে দেখার মতো আছে। এইসকল চিন্তা-ভাবনাও খোদাভীতি ও আখিরাত-মুখিতার প্রকাশ।

মুমিনের জীবন কখনো ‘বেঘোর নিদ্রার জীবন’ হতে পারে না। প্রাত্যহিক পরিস্থিতি, রুযি-রোযগারের দৌড়ঝাঁপ, অসুস্থতা-সংকট কোনো কিছুই তার উন্নতির পথে পথচলাকে থামিয়ে দিতে পারে না। দেহের বাহ্যিক সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিচিত্র কর্ম-ব্যস্ততার মধ্যেও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ, শ্বাস-প্রশাস, রক্ত-সঞ্চালন যেমন চলমান থাকে তেমনি বাহ্যিক সকল অবস্থা ও পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার মধ্যেই চলতে থাকবে মুমিনের আখিরাত-অভিমুখী উন্নতির অভিযাত্রা।

মাহে রমযান আমাদের মাঝে হাজির হয় সেই উন্নতি-চেষ্টার জ্বালানী নিয়ে। এ মাসের হক্ক আদায়ের মাধ্যমে আমরা অর্জন করে নিতে পারি আমাদের আগামী জীবনের পথচলার শক্তি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখুন, কর্মক্ষম ও কর্মচঞ্চল রাখুন, কল্যাণের পথের অভিযাত্রী হওয়ার ও সেই যাত্রাকে অব্যাহত রাখার তাওফীক দান করুনÑ আমীন।