ফিতনার যুগ : ফিতনা থেকে বাঁচব কীভাবে?

আমরা অনেক সময় বলি, বর্তমান যুগটি ফিতনার যুগ। কথাটা অবাস্তব নয়। ফিতনা যদিও সব যুগেই ছিল, কিন্তু নবী-যুগ থেকে দূরত্ব যত বাড়ছে ফিতনার অন্ধকারও ততই বাড়ছে। তাছাড়া বর্তমান যুগের ফিতনাসমূহের মুখোমুখীও যেহেতু তারাই হচ্ছি, যারা এ যুগের মানুষ; তাই স্বভাবতই সমকালীন ফিতনাসমূহই আমাদের মন-মস্তিষ্কে বেশি রেখাপাত করছে। ফিতনা কম হোক বা বেশি, সব যুগেই তা ছিল। কিয়ামতের আগে আরো যে কত ভয়াবহ ফিতনা প্রকাশিত হবে- তা হাদীস শরীফের মনোযোগী পাঠকের নিশ্চয়ই অজানা নয়। কাজেই ফিতনা ও তার বিস্তারে সন্ত্রস্ত না হয়ে প্রতিটি ফিতনাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারা এবং তা থেকে বাঁচার সঠিক পথটি বুঝে নিতে পারাই হচ্ছে প্রথম কাজ। এ হলে ফিতনা থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়।

উম্মতে মুসলিমার প্রতি আল্লাহ তাআলার অতি বড় দয়া যে, ফিতনা-ফাসাদের যুগেও সিরাতে মুসতাকীম কোনটি তা জানার ও বোঝার উপায় আছে। আল্লাহ তাআলা কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শিক্ষাকে নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করেছেন, যার দ্বারা হক-বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে যায়। যত রকমের ফিতনাই প্রকাশিত হোক- কুরআন-সুন্নাহ্য় আছে ঐ ফিতনার স্বরূপ ও তা থেকে মুক্তির যথার্থ পথনির্দেশ। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কুরআন-সুন্নাহ থেকে মুক্তি ও সাফল্যের পথ পেতে হলে কুরআন-সুন্নাহ্র নির্দেশনার প্রতি আস্থা ও সমর্পন থাকতে হবে। মন-মস্তিষ্ককে উন্মুক্ত করতে হবে এবং সত্যিকারের মুখাপেক্ষিতা নিয়ে কুরআন-সুন্নাহ্র শরণাপন্ন হতে হবে। এ হলে আল্লাহ্র তাওফীকে সত্যকে বোঝা কঠিন হয় না। কঠিন সাধারণত তখনই হয় যখন এই সকল শর্ত পূরণে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়া হয়।

এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি কিংবা জাগতিক বিদ্যা-বুদ্ধিজনিত অহংবোধ। এই অহংবোধের প্রকাশ কখনো কখনো দ্বীনী রুচি ও পন্থা-পদ্ধতির ক্ষেত্রেও ঘটে। দ্বীনী ইলমের ধারক-বাহকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে তো ঘটেই। অথচ একথা যেমন স্পষ্ট যে, কুরআন-সুন্নাহ্ই হচ্ছে দ্বীনের বিশ্বাস, রুচি ও বিধি-বিধানের উৎস তেমনি এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, কুরআন-সুন্নাহ্র সঠিক ও যথার্থ জ্ঞান অর্জন করতে হবে আলিমদের নিকট থেকেই। কাজেই হক্কানী উলামা-সমাজের প্রতি অনাস্থা-অবজ্ঞার মনোভাব কুরআন-সুন্নাহ্র যথার্থ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অনেক বড় কারণ।

এখানে যে বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, আলেম হওয়া মানে ফেরেশতা হওয়া নয়, মাসুম হওয়াও নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বাভাবিক দ্বীনী প্রজ্ঞার অভাবে দু’ধরনের প্রান্তিক মনোভাবই লক্ষ্য করা যায় : মুসলিমসমাজে ক্ষেত্রবিশেষে অতিভক্তি প্রবণতার যেমন অভাব নেই তেমনি ঢালাও অভিযোগ ও অবাস্তব সমীকরণেরও যেন কোনো শেষ নেই। জাগতিক ক্ষেত্রে অবশ্য এ ধরনের ঢালাও অভিযোগের প্রবণতা কম দেখা যায়। সব শ্রেণি-পেশার লোকদের মধ্যেই ভালো-মন্দ উভয় শ্রেণির লোক থাকলেও সেখানে কিন্তু আমরা ভালো ও যোগ্য লোকটিকে ঠিকই খুঁজে নিই। অন্তত খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি; বরং খোঁজাখুঁজিটাকে জীবনযাত্রার সাধারণ নিয়মই মনে করি। কিন্তু ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেন রাজ্যের অবসাদ এসে ভর করে। আর তাই খোঁজাখুঁজির কষ্টটুকু স্বীকার করার পরিবর্তে ঢালাও অভিযোগ দায়ের করে দায়মুক্ত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এভাবে দুনিয়াতে বিবেকের দংশন থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া গেলেও আখিরাতে আল্লাহ তাআলার প্রশ্ন থেকে বাঁচা যাবে না।

ধর্মীয় ক্ষেত্রেও যোগ্য ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের সন্ধান অপরিহার্য। এখানে বিচার-বিবেচনাহীন অন্ধভক্তি যেমন ক্ষতিকর তেমনি ঢালাও অভিযোগ-প্রবণতাও। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান মুসলিমসমাজে উভয় শ্রেণির ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। নানামুখী ফিতনার প্রসার ও বিস্তারের এটাও অন্যতম প্রধান কারণ।

এই ফিতনা-গ্রস্ততা থেকে মুক্তির জন্য দ্বীনী ইলমের পঠন-পাঠনে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের যেমন কিছু করণীয় আছে তেমনি আছে সাধারণ মুসলিম, যারা আলিমদের নিকট থেকে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করছেন তাদেরও। সাধারণ মুসলিম জনগণের কর্তব্য হচ্ছে, অহং ও শৈথিল্য উভয় প্রকারের মনোভাব ত্যাগ করে সঠিক দ্বীনী ইলমের অন্বেষণ ও অনুসরণে কৃতসংকল্প হওয়া এবং দ্বীনী ইলমে পারদর্শী মুত্তাকী ব্যক্তিত্বের সন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া। হক্কানী উলামায়ে কেরামের সাহচর্যের মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহ্র সঠিক ইলম অর্জন করে সে অনুযায়ী জীবন ও কর্মকে সজ্জিত করার চেষ্টা করা।

অন্যদিকে দ্বীনী শিক্ষার পঠন-পাঠনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে বক্তব্য ও লেখালেখির পাশাপাশি বাস্তব জীবনে ইসলামী বিধি-বিধান পালনে আরো বেশি সচেতন হওয়া। অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে সন্তুষ্ট না থেকে একজন দাঈর যে পর্যায়ের ভালো অবস্থানে থাকা কাম্য ঐ অবস্থানের দৃষ্টান্ত আরো বেশি স্থাপনে সচেষ্ট হওয়া। নিঃসন্দেহে এই অবক্ষয়ের যুগেও দ্বীনের তালীম ও দাওয়াতের সাথে যারা জড়িত সামগ্রিক বিচারে তাদের অবস্থা অন্যদের চেয়ে উন্নত। কিন্তু এই ‘অপেক্ষাকৃত উন্নত’ অবস্থায় সীমাবদ্ধ না থেকে সীরাতুন নবী ও সীরাতে সাহাবার মানদণ্ডে নিজেদের স্বভাব-চরিত্রকে বিচার করা। ইসলামী শরীয়তে যা কিছু গর্হিত ও বর্জনীয় তা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকা।

কে না জানেন যে, খাস-আম সকল মুসলিমের যাঁরা আদর্শ সেই আম্বিয়ায়ে কেরাম, বিশেষত শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, করণীয়-বর্জনীয় উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা ছিলেন উম্মতের আদর্শ। যে আদর্শ তারা নিয়ে এসেছিলেন সেই আদর্শের শ্রেষ্ঠ ও প্রথম অনুসারী ছিলেন তাঁরাই। দাওয়াতের উপায় ও পন্থা নির্ধারণেও তাঁরাই আমাদের আদর্শ। তাদের অনুসরণের মধ্যেই আমাদের সাফল্য, দাওয়াতের সাফল্য। তাঁদের এই আদর্শ থেকে বিচ্যুতি শুধু দাঈর জন্যই আত্মঘাতী নয়, ইসলামী দাওয়াতের জন্যেও ক্ষতির কারণ। একইসাথে সর্বস্তরের জনগণের পক্ষে দাওয়াতকে তার প্রকৃতরূপে গ্রহণের পথেও বড় অন্তরায়। তাছাড়া ইসলামী দাওয়াতের বিপক্ষ শক্তির জন্যে ঢালাও অভিযোগ ও অন্যায় প্রচারণারও অনেক বড় ছুতা।

বর্তমান ফিতনার যুগে ইসলামের সঠিক শিক্ষার উপরে থাকতে হলে এবং ইসলামের সঠিক শিক্ষা সর্বস্তরের জনগণের সামনে স্পষ্ট ও বাধাহীনভাবে উপস্থাপন করতে হলে ইলমী-আমলী উভয় ক্ষেত্রে অগ্রসরতা ও অবিচলতার কোনো বিকল্প নেই। এককথায় দাঈ-মাদউ উভয় শ্রেণির মাঝে ইলম ও তাকওয়ার ব্যাপক চর্চাই হচ্ছে ফিতনার যুগে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার প্রধান উপায়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।