দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস
বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ২৯ দেশে; আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৭৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে চীনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশ কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে, কিন্তু মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
এ ভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩৬০ জন, যাদের মধ্যে ১৫ জন ছাড়া বাকি সবার মৃত্যু ঘটেছে চীনে। আগেই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এবার সংস্থাটির প্রধান টেড্রস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে পরিষ্কার যোগসূত্র না থাকা রোগী বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, চীনের বাইরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম। তবে যে প্যাটার্ন বা ধরনে এ রোগের সংক্রমণ ঘটছে, তা উদ্বেগজনক। কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না আসা বা চীন সফর না করেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ইরানে নতুন করে সংক্রমণ ঘটা ও মৃত্যুর ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। ভাইরাসটিকে ঠেকানোর মতো সুযোগ সীমিত বা সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৯ বছর বয়সি এক বাংলাদেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সিঙ্গাপুরে পাঁচ বাংলাদেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর আরব আমিরাতে এক বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। আমিরাত নিউজ এজেন্সির খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার এক জন বাংলাদেশি ছাড়াও ফিলিপাইনের এক নাগরিক একই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে দুজনের অবস্থা স্থিতিশীল। দুজনই হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। ইরানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো দুই জন মারা গেছেন। এ নিয়ে দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চার জনের মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটল। ইরানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশটির সব শহরেই এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। শুক্রবার ইতালিতে ৭৮ বছর বয়সি এক ব্যক্তি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ নিয়ে দুই জন মারা গেল ইতালিতে। লেবাননে ৪৫ বছর বয়সি এক নারীর করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মিসর, ইসরায়েলেও এ রোগী পাওয়া গেছে।
কানাডা বলছে, তাদের যে নয় জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন, এর মধ্যে এক জন সম্প্রতি ইরান থেকে ফিরেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং সে-কিউন বলেন, তার দেশ জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দিয়েগু ও চেংদো শহরকে ‘স্পেশাল কেয়ার জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। দিয়েগু শহরের রাস্তা এখন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশটিতে তিন জন সেনা সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সব সেনা স্থাপনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ডব্লিউএইচওর প্রধান বলেন, চীনসহ অন্যান্য দেশ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর এখনো সুযোগ রয়েছে। সম্ভাব্য মহামারি ঠেকাতে সব দেশকে আরো বেশি প্রস্তুত থাকতে হবে।
চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার দেশটির মূল ভূখণ্ডে ৩৯৭ জনের শরীরে নতুন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৮৮৯ জন। সব মিলিয়ে চীনে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ২৮৮ জনে। আর ২৯টি দেশ ও তিনটি অঞ্চল মিলিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৭৭ হাজার ৭৬৭ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সাউথ চায়না মরনিং পোস্ট। শুক্রবার চীনে মোট ১০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনা ভাইরাসে, এর মধ্যে হুবেই প্রদেশেই মারা গেছেন ১০৬ জন। তাতে চীনের মূল ভূখণ্ডে নতুন করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৪৫ জন। চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে নিহতদের মধ্যে ইরানে চার জন, জাপানে তিন জন, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়ায় দুজন করে এবং ফিলিপাইন, ফ্রান্স, তাইওয়ান ও ইতালিতে একজন করে মারা গেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েগু শহরে একটি চার্চে প্রার্থনায় যোগ দেওয়া ১৬৯ জন মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ঐ সম্প্রদায়ের নয় হাজার সদস্য স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকার এবং পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইসরাইলে একজন আক্রান্ত হয়েছেন। চীনের চৌহদ্দি এবং জাপানের প্রমোদতরির বাইরে দক্ষিণ কোরিয়াতেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। উপকূলে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা প্রমোদতরি ডায়মন্ড প্রিন্সেসের ৬৩৯ জনসহ জাপানে নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৭২ জনে।
নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে অযথা আতঙ্ক রোগটি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে বলে আবারো হুঁশিয়ার করেছে আইইডিসিআর। গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, অযথা যেন গুজব না ছড়ায় সেদিকে সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে। বিদেশি নাগরিক বা বিদেশফেরত অনেকে নানারকম হেনস্তার শিকার হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অতি-উত্সাহী লোকের বাড়াবাড়ি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। আমাদের কাছে তথ্য এসেছে বাড়িওয়ালারা তাদের বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না। একজন চীনা নাগরিক তার ভাড়া করা বাসায় উঠতে গেলে তাকে উঠতে দেওয়া হয়নি। তিনি পরে একটি হোটেলে রাত কাটিয়েছেন। কারও এ ধরনের কাজ পুরো দেশকে ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে মন্তব্য করে অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, কেউ সত্যিই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এবং হেনস্তার কারণে তাকে বাইরে থাকতে হলে রোগটি বড়ো আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দুই মাসে চীনের ক্ষতি ১৮৫০০ কোটি ডলার
করোনা ভাইরাস কাবু করে ফেলেছে চীনের অর্থনীতিকে। চীন দ্বিতীয় বৃহত্ অর্থনীতির দেশ হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীততেও। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) চীনের ক্ষতি হতে পারে ১৮ হাজার ৫০০ কোটির ডলারেও বেশি। কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, ভোক্তা ব্যয় এবং পর্যটন খাতকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী এমন আশঙ্কার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
করোনা ভাইরাস রোগী পাওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় স্যামসাংয়ের কারখানা বন্ধ
দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক দিনেই বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে; এক কর্মীর দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর স্যামসাং ইলেক্ট্রনিক্স তাদের মোবাইল ফোন তৈরির একটি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। দেশটির সেন্টার্স ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বরাত দিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার ২২০ জনের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩৩ জনে। দায়েগু শহরের কাছে গুমিতে স্যামসাংয়ের একটি মোবাইল সেট তৈরির কারাখানায় এক কর্মীর দেহে শনিবার করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে। এরপর ওই কারখানা সোমবার সকাল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে স্যামসাং কর্তৃপক্ষ।