আলোচনায় খালেদা জিয়া

নেতা ও আইনজীবীদের ব্যর্থতা : মুক্তি চেয়ে পরিবারের চিঠি

রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার অঙ্গীকার, সভা-সমাবেশে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নানা রকম হম্বিতম্বিও দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। আইনজীবীরাও দিয়েছেন একের পর এক আশ্বাস। কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় দেখার পর প্রতিবারই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বজনরা। দল ও আইনজীবীরা না পারলে পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্যোগের প্রস্তাবও দিয়েছেন তারা। কিন্তু প্রতিবারই নেতা ও আইনজীবীরা জানিয়েছেন রাজপথে ও আইনি লড়াইয়ে তাকে মুক্ত করা হবে। কিন্তু দুই বছরেও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার মতো দৃশ্যমান কোন সফলতা দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় এবার এগিয়ে এসেছেন পরিবারের সদস্যরা। বেগম জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা, বয়স ও মানবিক দিক বিবেচনায় উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে তাঁর পরিবার। কর্তৃপক্ষ সেটি মেডিকেল বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছে মতামতের জন্য। চিঠিতে সরকারের কাছেও দাবি জানানো হয়েছে মুক্তির। পরিবারের আবেদনের পর থেকেই আলোচনা শুরু হয়েছে বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়ে। প্যারোল নাকি চিকিৎসার জন্য সেটি নিয়েও চলছে গুঞ্জন।

আবেদন পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিএসএমএমইউ ভিসি প্রফেসর ডা. কনক কান্তি বড়–য়া বলেন, আমরা বেগম জিয়ার পরিবারের কাছ থেকে একটি আবেদন পেয়েছি। সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা করাতে চান। চিঠিটি আমরা তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছি। বোর্ডই ঠিক করবে বেগম জিয়ার চিকিৎসা দেশে-নাকি বিদেশে হবে। কনক কান্তি আরও জানান, বেগম জিয়া যদি চান তাহলে বিএসএমএমইউতেই তার উন্নত চিকিৎসা সম্ভব। এজন্য তাঁর সহযোগিতা প্রয়োজন। গত মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত শেষে বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, বেগম খালেদা জিয়া এতটায় অসুস্থ যে, তিনি ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। সে যে অবস্থায় এসেছিল এখন তার শারীরিক অবস্থা সেই অবস্থায় নেই। সে আগে হেঁটে চলে বেড়াত। এখানে ডাক্তাররা যে চিকিৎসা দিচ্ছেন তাতে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সেজন্য তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, তার বাথরুম থেকে বেডের দূরত্ব খুব সামান্য। সেখানে যেতেও তার ২০ মিনিট সময় লাগে। তার বাঁ হাতটা সম্পূর্ণ বেঁকে গেছে, এখন ডান হাতটাও বেঁকে যাচ্ছে। সে খেতে পারছে না, খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে। জ্বর আছে গায়ে, শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। এমতাবস্থায় উনার উন্নত চিকিৎসা খুবই প্রয়োজন। উনার শরীর এত খারাপ এই মুহূর্তে যদি উনার উন্নত চিকিৎসা না দেওয়া যায় তাহলে উনার কী হবে-এটা আমরা বলতে পারছি না। সেলিমা ইসলাম বলেন, আমাদের আবেদন, তাকে মুক্তি দেওয়া হোক। অন্তত উন্নত চিকিৎসাটুকু করতে পারি যেন- এটাই আমাদের একমাত্র আবেদন। সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, উনার শারীরিক অবস্থা, শ্বাসকষ্ট, উনার বয়স তাদের (সরকার) বিবেচনা করা উচিত। মানবিক দিকটা বিবেচনা করে তাকে মুক্তি বা জামিন দেওয়া উচিত। সরকারের কাছে আমরা এটাই আবেদন করছি যে, তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করছি।

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করা হয়নি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘তাকে (খালেদা) প্যারোলে মুক্তি দেয়ার জন্য পরিবার থেকে বিভিন্নভাবে আবেদন করা হয়েছে। যারা এ আবেদন করেন, টেলিভিশনের পর্দায় আবেদন করেন। আমি সকালেও খবর নিয়েছি, তারা লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্যারোলের জন্য আবেদন করেননি। এখন লিখিত আবেদন করলেও এ আবেদন কারণসহ যুক্তিসংগত হতে হবে। যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যারোল বিবেচনা করতে পারেন না, সরকার বিবেচনা করতে পারে না।’

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৮০’র দশকে দেশ, গণতন্ত্র ও দল যখন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় তখনই গৃহবধূ বেগম জিয়া রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। তার নেতৃত্বেই দেশে ৯ বছর আন্দোলনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই আন্দোলনে গণতন্ত্র ও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা-দাবির প্রতি আপোষহীন মনোভাবের কারণে খেতাব পান আপোষহীন নেত্রীর। সেই আন্দোলনের সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ৯১’র নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতাও পায়। এর পর ৯৬’র নির্বাচন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনেও রাষ্ট্র ক্ষমতা পায় বিএনপি। ৯৬’র আরেকটি নির্বাচনে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্র ক্ষমতা ও দল পরিচালনা করতে গিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন বিএনপি প্রধান। তাই তার সুখে যেমন দেশের কোটি কোটি মানুষ হাসে, তার ব্যথায়ও কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। অসুস্থতার খবর শুনলে গ্রামে-গঞ্জে, শহরের হাজারো মানুষ নফল নামাজ আদায় করেন, রাখেন রোজা, দোয়া-মোনাজাতেও চোখের পানি ফেলেন কোটি কোটি মানুষ।

২ বছর ৬ দিন ধরে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। মিথ্যা, সাজানো ও রাজনৈতিক মামলায় তাকে সাজা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করে আসছে দলটির নেতা ও আইনজীবীরা। এজন্য ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই দলটির নেতারা আন্দোলন এবং আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তাঁকে মুক্ত করার কথা বলে আসছেন। পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশ, সেমিনার, কয়েক ঘণ্টার প্রতীকী অনশনও করেছেন তারা। দলের প্রচেষ্টায় খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হওয়ায় কয়েকবার তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিজেরা উদ্যোগ নেয়ার কথা বললেও বিএনপির সিনিয়র নেতা এবং আইনজীবীরা বারবারই আশ্বস্ত করছেন মুক্ত করার। কিন্তু দুই বছর পরও যখন বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে নেতা ও আইনজীবীরা ব্যর্থ হয়েছেন তখন এগিয়ে এসেছেন পরিবারের সদস্যরা। যেকোন উপায়ে তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মুক্ত করতে চান। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা এবং মানবিক দিক বিবেচনায় বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউ’র ভিসির কাছে আবেদন করেছেন তারা।

দুই বছর আগে পায়ে হেঁটে কারাগারে গিয়েছিলেন। নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন-পরিত্যক্ত কারাগারে একমাত্র কারাবন্দী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে রাখা হয়। কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই শারীরিক নানা অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ার অভিযোগ করে আসছে দলটির নেতাকর্মীরা। অসুস্থতার কারণে গতবছর এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ডা. শামীম বলেন, এসব জটিলতার কারণে তার হাত এবং পায়ের ছোট ছোট জয়েন্টগুলোসহ শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট ফুলে গেছে এবং তাতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। যার কারনে জয়েন্টগুলি শক্ত এবং বাঁকা হতে চলেছে যা কিনা অচিরেই স্থায়ী রূপ ধারণ করতে পারে এবং যার কারণে বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা, ওঠাবসা এমনকি নিজ হাতে খাবার পর্যন্তও খেতে পারছেন না।

এমন অবস্থায় বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য রাজপথের পাশাপাশি আইনি লড়াই চালিয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দলটির নেতা ও আইনজীবীরা। বিগত ৬টি নির্বাচনে বেগম জিয়া যাদের এমপি, মন্ত্রী বানিয়েছেন, তার সরকারের সময় নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাঁর খালেদা জিয়ার এই দুঃসময়ে তাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এখনো যে কোন নির্বাচন এলে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অভাব হয় না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ৩০০ আসনের জন্য ৪ হাজার ৫৮০জন এমপি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে তাদের ৫ শতাংশ প্রার্থীকেও পাওয়া যায় না। এমনকি সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে যে ৮জন এমপি শপথ গ্রহণ করেছেন তাদের একজনও এখন পর্যন্ত কোন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করায় ক্ষোভ রয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে।

পরিবারের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দল থেকে যেহেতু আবেদন করা হয়নি সে বিষয়টি আমরা জানি না। তিনি বলেন, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় বিনা অপরাধে দুই বছরের বেশী হলো কারাবন্দী রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। জেলের ভেতর হত্যার চেষ্টা চলছে। ৭৫ বছর বয়সী দেশনেত্রীর অবস্থা চরম খারাপ। এখনি মুক্তি দিয়ে দ্রুত উন্নত সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে আমরা তাঁর জীবনহানীর আশঙ্কা করছি।

খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য পরিবার কি আবেদন করেছেন জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, এটা সম্পর্কে আমরা ঠিক বলতে পারব না। কারণ এটা আমরা করিনি। তার পরিবার থেকে প্যারোলের আবেদন করা হয়েছে কিনা সেটাও আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, আমরা তার (খালেদা জিয়া) মুক্তির জন্য আইনের সবগুলো বিষয় চেষ্টা করেছি, এখনো করে যাচ্ছি আইনগতভাবে। আমরা তো সব সময় দাবি জানাচ্ছি, আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমেও জানাচ্ছি, আমরা হোম মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলেছি, পার্লামেন্টেও জানানো হয়েছে। এখন পুরো বিষয়টাই সরকারের হাতে। দ্য বল ইজ ইন দেয়ার কোর্ট। খালেদা জিয়াকে ‘শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে জামিন না দিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে’ বলেও অভিযোগ করেন বিএনপির এই নেতা।