আরও ৭০০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়ল গ্রামীণফোনের

বিটিআরসির সঙ্গে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব বিরোধ নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যেই নতুন করে মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের বড়ো অঙ্কের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ফাঁকি বের হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট অফিসের বিশেষ নিরীক্ষায় গ্রামীণফোনের প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে।

এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কমিশন পরিশোধকালে কর্তিত ভ্যাট সরকারের ঘরে জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে সম্প্রতি প্রাথমিক দাবিনামা জারি করা হয়েছে। কিছু প্রক্রিয়া শেষে শিগগিগরই চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হবে। গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে এর বাইরেও বিভিন্ন খাতে ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি কিংবা পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা দাবি করেছে। এ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা চলছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক বসানোরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এমন আলোচনার মধ্যেই গ্রামীণফোনের নতুন করে বিশাল অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তারা বিশেষায়িত নিরীক্ষার মাধ্যমে গ্রামীণফোনের ভ্যাট পরিশোধ না করার বিষয়টি বের করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব ফাঁকি-সংক্রান্ত নানা অভিযোগ নিয়ে যখন এত কঠিন পরিস্থিতি, তখন এমন তথ্য আমাদেরও বিস্মিত করেছে।’

তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে একধরনের ‘গোঁয়ারতুমি’ রয়েছে। স্থান ও স্থাপনা ভাড়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অন্য মোবাইল ফোন অপারেটর রবি কিংবা বাংলালিংক অর্থ পরিশোধ করলেও গ্রামীণফোন ঝুলিয়ে রাখছে, পরিশোধ করছে না। মামলায় ফেলে বছরের পর বছর আটকে রাখতে চায়।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে চার বছরের গ্রামীণফোনের বিভিন্ন নথিপত্র নিরীক্ষা করে এসব রাজস্বের অর্থ পরিশোধ না করার বিষয়টি বের হয়েছে। আলোচ্য সময়ের ভ্যাট আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান সেবা গ্রহণের পর সেবার মূল্য বা কমিশন পরিশোধকালে উেস ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কর্তন করে সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি চার বছর ধরে এ অর্থ জমা দেয়নি। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। কমিশন প্রদানকালে আলোচ্য ভ্যাট ছাড়াও বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনকালে নির্বাচন কমিশনে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখার জন্য ভোটারের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে। এর বিপরীতে নির্বাচন কমিশনকে প্রদত্ত ফির ওপর ভ্যাট কর্তনের কথা। কিন্তু ঐ ভ্যাট এনবিআরকে পরিশোধ করেনি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়েকে লিজের সেবামূল্য পরিশোধের সময় আদায়কৃত ভ্যাটও সরকার পায়নি বলে জানিয়েছে এনবিআর। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এনবিআরের প্রাপ্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা জমা দেয়নি।

বিদ্যমান ভ্যাট আইন অনুযায়ী, প্রাথমিক দাবিনামা জারির পর অর্থ পরিশোধ কিংবা জবাব দেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়। অর্থ পরিশোধ না হলে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়। এরপর আরো কিছু প্রক্রিয়া শেষে এনবিআর চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবও জব্দ করতে পারে। এর আগে অন্য আরেকটি মোবাইল ফোন কোম্পানির ব্যাংক হিসাব জব্দ করে অর্থ আদায়ের মতো নজির রয়েছে।

ইস্যুটি নিয়ে গ্রামীণফোনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

সূত্র জানিয়েছে, এর আগেও গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত সিম পরিবর্তনের নামে নতুন সিম বিক্রি করে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। ঐ ইস্যুতে চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠলেও গ্রামীণফোনের কাছেই দাবি ছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, সিম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিটিআরসির নিয়ম লঙ্ঘন করেছিল গ্রামীণফোন। অর্থাৎ, আইনবহির্ভূতভাবে সিম পরিবর্তনের স্থলে নতুন সিম ইস্যু করা হয়েছিল। স্থান ও স্থাপনা ভাড়া-সংক্রান্ত পাঁচ মামলায়ও বড়ো রাজস্ব আটকে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে। এই ইস্যুতে অন্য মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো অর্থ পরিশোধ করলেও গ্রামীণফোন দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। নতুন করে যুক্ত হলো আরো প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির দাবিকৃত সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ভ্যাটসহ সব কর মিলিয়ে এনবিআরের দাবিকৃত পাওনা রয়েছে ৪ হাজার ৮৬ কোটি টাকা।