পশ্চিমে পাড়ি জমানোর আগে একটু ভাবুন : কুবরুস সফর : কিছু শিক্ষা
[বয়ান : ১০ যিলকদ ১৪৪০ হি. মোতাবেক ১৪ জুলাই ২০১৯ ঈ. রবিবার, সাপ্তাহিক ইছলাহী মজলিস- জামে মসজিদ, দারুল উলূম করাচী।]
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কুবরুস দ্বীপে
এরপর মাল্টা থেকে আমাদের সফর হয়েছে কুবরুস (সাইপ্রাস) দ্বীপে। এটা ইউরোপে অবস্থিত একটি বড় দ্বীপ।
এর বিজয়ের সাথে জড়িয়ে আছে বড় বিস্ময়কর ইতিহাস এবং তা বড় শিক্ষণীয়ও বটে।
ঘটনা হল, হযরত উসমান রা.-এর খেলাফতের যামানা ছিল। তৎকালীন শামের গভর্নর ছিলেন হযরত মুআবিয়া রা.। মুজাহিদ বাহিনীর প্রতি হযরত ওমর রা.-এর নির্দেশ ছিল- তোমরা এমন কোথাও অভিযানে যাবে না যেখানে আমার এবং তোমাদের মাঝে সমুদ্র প্রতিবন্ধক হয়। কেননা সে সময় সমুদ্রযাত্রা খুবই খতরনাক ছিল। জাহাজগুলো পাল তুলে চলত। বাতাস সেগুলোকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। তাই কখনো কখনো দেখা যেত, আপনি কোথাও যেতে চাচ্ছেন, আর কিশতি আপনাকে ভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। এখনকার মতো এত শক্তিশালী জাহাজ তো তখন আবিষ্কার হয়নি। তাই সমুদ্রে সেগুলো ডুবে যাওয়ারও শঙ্কা থাকত।
তো হযরত ফারুকে আযম রা. চাইতেন, আমাদের মুজাহিদ বাহিনী যেন শঙ্কামুক্ত থাকে। তাই সাধারণভাবে তিনি মুজাহিদীনকে নৌ অভিযানে বের হতে নিষেধ করতেন।
হযরত মুআবিয়া রা. শামের শাসক ছিলেন। যখন হযরত উসমান রা.-এর যামানা আসল তিনি হযরত উসমান রা. থেকে নৌ অভিযানের অনুমতি নিলেন।
ঘটনার প্রেক্ষাপট হল, ওই সময় রোমকদের শাসন চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিল। যে কোনো সময় তারা মুসলমানদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আশঙ্কা ছিল। হযরত মুআবিয়া রা. ছিলেন অত্যন্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি হযরত উসমান রা.-এর নিকট আবেদন করলেন যে, আপনি অনুমতি দিয়ে দিন, আমরা নৌ পথে কুবরুসে অভিযান চালাব। কেননা এই দ্বীপটি আমাদের ভূ-খ-ের নিকটে অবস্থিত। যেকোনো মুহূর্তে রোমকরা আমাদের উপর হামলা করে বসতে পারে।
হযরত মুআবিয়া রা.-এর অনুমতি চাওয়ার পর হযরত উসমান রা. প্রথমে চিন্তা-ভাবনা করেছেন, চুপচাপ থেকেছেন; পরে অনুমতি দিয়েছেন।
হাদীস শরীফে কুবরুস বিজয়ের প্রতি ইঙ্গিত
এই অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি হাদীস কার্যকর ছিল- তাতে একটি সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। হাদীসটি হল, হযরত উম্মে হারাম রা. বড় সাহাবিয়া ছিলেন। হযরত আনাস রা.-এর খালা ছিলেন। হযরত উবাদা ইবনে ছামেত রা. ছিলেন তার স্বামী। এবং স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার দুধসম্পর্ক ছিল। নবীজী মাঝে মাঝে হযরত উম্মে হারামের ঘরে যেতেন। মাঝে মাঝে সেখানে বিশ্রামও নিতেন। যেহেতু নবীজীর সাথে হযরত উম্মে হারাম রা.-এর দুধসম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল সে হিসেবে তিনি নবীজীর মাহরাম ছিলেন।
একদিন নবীজী তার ঘরে আগমন করলেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন। নবীজীর চোখ লেগে গেল। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর নবীজী জেগে উঠলেন। চেহারা মোবারকে হাসির রেখা ফুটে ছিল। হাসতে হাসতে জেগে উঠলেন। হযরত উম্মে হারাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কী কারণে আপনি এভাবে হাসছেন? নবীজী বললেন, স্বপ্নে আমাকে দেখানো হয়েছে যে, আমার উম্মতের এক মুজাহিদ-কাফেলা সমুদ্রে এভাবে সফর করছে যেমন রাজা মসনদে বসে থাকে। অর্থাৎ এতটা ইতমিনান, নিশ্চিন্ত ও নির্বিঘœ ছিলেন তারা, যেভাবে নিশ্চিন্ত মনে বাদশাহ তার আসনে বসে থাকে। হযরত উম্মে হারাম রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি দুআ করে দিন, যাতে আমিও তাদের সাথে শামিল থাকতে পারি। নবীজী বললেন, তুমিও তাদের সাথে থাকবে।
এ বলার পর নবীজীর চোখ আবার লেগে গেল। দ্বিতীয়বার জেগে ওঠার পরও নবীজীর চেহারায় হাসির আভা ছিল। এবারও উম্মে হারাম রা. জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কী জন্য হাসছেন? নবীজী সে-ই জবাব দিলেন, আমি আমার উম্মতের একটি জামাতকে দেখেছি তারা সমুদ্রে জিহাদের সফর করছে। তাদের অবস্থা এমন যেমন বাদশাহ সিংহাসনে বসে থাকে। হযরত উম্মে হারাম রা. এবারও বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! দুআ করে দিন, যাতে আমিও তাদের সাথে থাকতে পারি। নবীজী বললেন, তুমি প্রথম জামাতে শামিল থাকবে; দ্বিতীয় জামাতে নয়। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯১২)
এ রেওয়ায়েতে নবীজী কেবল নৌ অভিযানের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন; এমনটি নয়। তাদের জন্য সুসংবাদও দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার নিকট তারা মাকবুল এবং পছন্দনীয় বান্দা হবেন।
তো হযরত মুআবিয়া রা. সর্বপ্রথম হযরত উসমান রা.-এর অনুমতিক্রমে নৌপথে অভিযান চালিয়ে কুবরুসে হামলা করেন। হযরত উবাদা ইবনে ছামেত রা. যিনি হযরত উম্মে হারামের স্বামী ছিলেন তিনি তাতে শরীক ছিলেন এবং হযরত উম্মে হারামও সেই কাফেলায় ছিলেন। এভাবে নবীজীর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হল। তারা গিয়ে কুবরুসে হামলা করলেন এবং চতুর্দিক থেকে তা ঘেরাও করে তাদেরকে পরাজিত করলেন। এভাবে কুবরুস বিজিত হল।
এটা ছিল সমুদ্র পথে ইউরোপ অভিমুখে মুসলমানদের সর্বপ্রথম অগ্রযাত্রা। কেননা কুবরুস হল ইউরোপের একটি দ্বীপ। আর তা হযরত উসমান রা.-এর খেলাফত আমলে হযরত মুআবিয়া রা.-এর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে।
কুবরুস বিজিত হল। সেখানে উম্মে হারাম রা. যাওয়ার পথে অথবা ফেরার পথে, দুই ধরনের রেওয়ায়েতই পাওয়া যায়, সওয়ারির উপর ছিলেন, সওয়ারি তাকে ফেলে দেয়। এতে তার ঘাড় ভেঙ্গে যায় এবং সেখানেই তার ওফাত হয়ে যায়। লোকমুখে প্রসিদ্ধ আছে, আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন, কুবরুসে তার কবর রয়েছে। এছাড়া আরো ছয়জন সাহাবীর কবরও সেখানে রয়েছে। হয়ত সেই জিহাদে তারা শহীদ হয়ে থাকবেন।
সেখানে যাওয়ার পর অন্যরকমের এক অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে; সাহাবায়ে কেরাম কীভাবে এত দূর দূর সফর করে এখানে এসেছেন! এত এত কুরবানী করে কুবরুস জয় করেছেন! ওই যমানা হিসেবে এটা কত দূর এলাকা না! একদিকে বায়রুত, আরেকদিকে কুবরুস। সমুদ্রের এপার ওপার সামনাসামনি।
হযরত অবুদ দারদা রা.-এর শঙ্কা প্রকাশ
রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়, মুজাহিদীনের এই কাফেলায় বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবুদ দারদা রা.-ও শামিল ছিলেন। তিনি অত্যন্ত উঁচু তবকার সাহাবী ছিলেন।
তাঁর সম্পর্কে বর্ণনায় পাওয়া যায়, যখন মুসলমানদের হাতে কুবরুস বিজিত হল এবং দুশমনরা সব অবদমিত হল, বিজয়ের সংবাদ পাওয়ার পর তিনি কাঁদতে আরম্ভ করলেন। সবাই জিজ্ঞাসা করল, হযরত! এটা তো আনন্দের মুহূর্ত, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নুছরত করেছেন। বিজয় দান করেছেন। আল্লাহর এই যমিনে ইসলামের কালিমা বুলন্দ করার তাওফীক দান করেছেন। এই মুহূর্তে তো কান্নার কোনো উপলক্ষ দেখা যাচ্ছে না। আপনি কাঁদছেন কী জন্য? তখন হযরত আবুদ দারদা রা. বড় তাৎপর্যপূর্ণ যে জবাব দিয়েছেন- সেটাই শুনাতে চাচ্ছি।
তিনি বললেন, আমি চিন্তা করছি, এই সমস্ত লোক, যারা কুবরুসের শাসক ছিল, এরা অত্যন্ত প্রতাপ ও শৌর্যবীর্যের অধিকারী ছিল। এদের শক্তি ও দাপটের ডংকা গোটা দুনিয়াজুড়ে বাজছিল। বিত্ত-বৈভব এবং উপায়-উপকরণ সবকিছু তাদের করায়ত্ত ছিল। পৃথিবীর ক্ষমতাধর পরাশক্তি হিসেবে তারা বিবেচিত হত। কিন্তু এরাই যখন আল্লাহর অবাধ্যতায় কোমর বাঁধল, আল্লাহ তাআলার আহকাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কুফুরিতে লিপ্ত হল এবং আল্লাহ তাআলার নাফরমানী করে ফিসক-ফুজূর ও পাপাচার-অনাচারে ডুবে রইল তো আল্লাহ তাআলা তাদের উপর আমাদেরকে চাপিয়ে দিয়েছেন। তাদের সকল শক্তি ও দাপট এবং ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি চূর্র্ণ করে দিয়েছেন। তাদের ত্রাস দূর হতে চলেছে। এখন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাদের উপর ক্ষমতা দিয়েছেন। ফলে এখন আমরা তাদের হাকিম ও শাসক। তো আমি এজন্য কাঁদছি যে, আজ তো আমরা বিজয়ী হয়েছি কিন্তু কাল যেন আমাদের এ হাল না হয় যে, আমরা আল্লাহ তাআলার নাফরমানী করতে থাকছি। আমাদের সমাজে আল্লাহ তাআলার নাফরমানীর সংস্কৃতি চালু হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলার আহকাম থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। তো আমি আশঙ্কা করছি, আমাদের আজ যে বিজয় ও নুছরত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হাছিল হয়েছে ফের না তা পরাজয়ে পরিবর্তিত হয়ে যায়! (দ্রষ্টব্য : আলবিদায়া ওয়াননিহায়া, ফাতহু কুবরুস অধ্যায়)
বিজয়ের সেই আনন্দের মুহূর্তে হযরত আবুদ দারদা রা. কেঁদে কেঁদে এই নির্মম সত্য কথাটি বলেছিলেন।
এখন আমরা সেখানে গিয়ে হযরত আবুদ দারদা রা.-এর সেই শঙ্কার বাস্তবতা স্বচক্ষে দেখতে পাই। অর্থাৎ কুবরুসের বিশাল একটা অংশ মুসলমানদের হাত থেকে ছুটে গিয়েছে।
আপনারা হয়ত শুনে থাকবেন, দীর্ঘদিন যাবৎ এ অঞ্চল নিয়ে গ্রীক এবং তুর্কীদের মাঝে যুুদ্ধ চলছিল। গ্রীকরা বলছিল, এটা আমাদের এলাকা, আমরা এখানে শাসন করব। তুর্কী সরকার বলছিল, আমরা এখানে শাসন করব, এটা আমাদের অঞ্চল। একপর্যায়ে জাতিসংঘ শালিসিতে কুবরুস দ্বীপকে দুই ভাগে বণ্টন করা হয়। একটি অংশ দিয়ে দেয় গ্রীকদের আরেক অংশ তুর্কীদের।
আজ বড় মর্মন্তুদ চিত্র হল, আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন, গ্রীকরা অধিকাংশ খ্রিস্টান অথবা ধর্মহীন, সেক্যুলার-দাহরিয়া। অর্ধ দ্বীপজুড়ে তাদের রাজত্ব। তারা কাফের এবং ঈসায়ী হওয়া সত্ত্বেও সেখানে তাদের আইন হল, এখানে কোনো জুয়াখানা হতে পারবে না। এ আইন ইসরাঈলেও রয়েছে- যেখানে ইহুদীরা শাসন করছে। অর্থাৎ সেখানে ক্যাসিনো থাকতে পারবে না।
আর তুর্কীদের অধীনে যে অংশ রয়েছে, বাস্তবে যা মুসলমানদের কব্জায় রয়েছে, সেখানে ক্যাসিনো ওপেন রয়েছে। এটি পর্যটকদের পছন্দের স্পট হওয়ার একটি কারণ এটাও যে, তাতে জুয়ার আসরে শরিক হওয়া যায়। এটা বড় ইবরতের জায়গা, যেখানে কাফেররা রয়েছে সেখানে তারা এগুলো থেকে বিরত থাকছে আর মুসলমান সেগুলো নিয়েই মত্ত হয়ে আছে।
এখন বলুন, মুসলমানদের দুর্দশা হবে না তো কার হবে! মুসলমান মার খাবে না তো কে খাবে!
কাফের হয়ে তারা এ গুনাহ থেকে বেঁচে আছে। একে খারাপ মনে করছে। একে বেআইনি ঘোষণা করছে। আর ঐ দ্বীপেরই মুসলিম অধ্যুসিত অঞ্চলে এগুলো সব অবাধে চলছে।
তো হযরত আবুদ দারদা রা. কেঁদে কেঁদে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আজ তা স্বচক্ষে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আজ তা আমাদের হাতে নেই- ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সেই দ্বীপে মুসলমানদের সংখ্যা অনেক। ইউনানীদের অংশেও এবং তুর্কীদের অংশে তো বটেই। আলহামদু লিল্লাহ, মসজিদও রয়েছে। অনেকে এ চেষ্টাও করছে যে, কীভাবে সেখানে ইসলাহের পরিবেশ কায়েম হয়। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আগের মুসলমানরা যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে এসেছে তারা তো নামাযের পাবন্দি করে। মসজিদগুলো তাদের উপস্থিতিতে ভরপুর থাকে, আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু নতুন প্রজন্ম শুধু ‘মুসলিম’ নামটুকু ধারণ করে রেখেছে। আল্লাহ হেফাযত করুন, বাকি সব কাজে তারা কাফেরদের পথে পুরো দমে চরে বেড়াচ্ছে।
পশ্চিমে পাড়ি জমানোর আগে একটু ভাবুন
বলতে গেলে বর্তমানে পশ্চিমের সকল দেশে মুসলমানদের এ করুণ হালত বিরাজ করছে। ইংল্যান্ডের অবস্থা তুলনামূলক কিছুটা ভালো। সেখানে মসজিদ-মাদরাসা রয়েছে। দ্বীনের কাজ হচ্ছে। তাবলীগের কাজ হচ্ছে। তারপরও আশি ভাগ মুসলমানের সন্তান-সন্ততির এ হালত যে, হয়ত তারা মুরতাদ হয়ে গেছে কিংবা হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, নাউযুবিল্লাহ। তাদের কর্ম অমুসলিমদের কর্মের মত। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশেই আজ এ হালত।
যারা এই আশা করে, যদি আমেরিকায় একটা চাকরি হয়ে যেত! কিংবা ইংল্যান্ডের ন্যাশনালিটি পাওয়া যেত! এজন্য দৌড়ঝাঁপ করে । হা পিত্তেশ করে। যার হাতে গ্রিনকার্ড চলে আসে তার যেন আর খুশি ধরে না। আর যে ইংল্যান্ড বা আমেরিকার ন্যাশনালিটি পেয়ে যায় সে এটাকে বহুত বড় সম্মান ও গর্বের বিষয় মনে করে। হাঁ, এমনটাই হালত। কিন্তু বন্ধু এখন তো তুমি শখে শখে সেখানে চলে যাবে। হয়তবা ভালো চাকরিও পেয়ে যাবে। অনেক অর্থকড়ি হবে। কিন্তু তোমার যে প্রজন্ম আসবে তার হেফাযত কে করবে?! কীভাবে করবে?!
পশ্চিমের দেশগুলোতে যখন যাই, সেখানে আমার সামনে তো ভালো দৃশ্যই বিরাজ করে, আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু প্রতিবারই এমন এমন সংবাদ আসে যে, এত এত মুরতাদ হয়ে গেছে। দ্বীন থেকে বেরিয়ে গেছে। বিলকুল ইসলাম ছেড়ে দিয়েছে। তো যারা আজ ন্যাশনালিটি বা গ্রিনকার্ড পাওয়াকে বড় সম্মানজনক ভাবছে, সেই আল্লাহর বান্দারা এটা আর খেয়াল করে না যে, আমরা তো কোনোভাবে চলে যাব। হতে পারে দ্বীনের উপর কায়েম থাকতেও পারি। আল্লাহর কিছু বান্দা রয়েছেন, যারা অবশ্য সন্তানদেরও হেফাযত করতে পারেন। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় আগামী প্রজন্ম রক্ষা করা বহুত মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এখন এটাকেই সম্মানজনক মনে করা হচ্ছে। বড় আশ্চর্যের ব্যাপার যে, আজ মুসলমান নিজের এবং সন্তানের দ্বীনকে কুরবান করে দুনিয়া হাছিল করছে।
এ জন্য আমি হযরত আবুদ দারদা রা.-এর বক্তব্যটি আরজ করলাম। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে একথা সঠিকভাবে বোঝার তাওফীক দান করুন। এটা বড় তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য। একথা তিনি ঠিক ঐ সময় বলেছিলেন যখন কুবরুস বিজিত হচ্ছিল।
তো ভাই! যে কথাগুলো বলা হল-
প্রথমত : কুরআনে কারীম মনেপ্রাণে গ্রহণ করুন। এর সহীহ শুদ্ধ তিলাওয়াত, অর্থ ও মর্মের সঠিক বুঝ ও উপলব্ধি এবং এর উপর আমল করাকে নিজের এবং সন্তান-সন্ততির জন্য আবশ্যক করে নিন।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনী ইলম শেখার যে সুযোগ দিয়ে রেখেছেন, দ্বীনী মালুমাত হাছিল করার জন্য যে উত্তম সোহবতের ইন্তেযাম করে দিয়েছেন, এর যথাযথ কদর করি। এখানে যদি কেউ দ্বীনদারী রক্ষার জন্য নেক পরিবেশ তালাশ করে তো তার জন্য এর অবারিত সুযোগ রয়েছে, আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু ওখানে এত সহজে এগুলো পাওয়া যায় না। পাওয়াটা বড় মুশকিল।
তো নেক সোহবত গ্রহণ করুন এবং সেখানে আসা যাওয়া অব্যাহত রাখুন। তাদের সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব রাখুন যাদের অন্তরে দ্বীনের ভালোবাসা-মহব্বত এবং দ্বীনের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা রয়েছে।
আর এই চেষ্টা ফিকিরে থাকা যে, পশ্চিমের কোনো দেশে চলে যাব। এটা দ্বীন ঈমানের জন্য কোনো মুনাসিব ফিকির নয়। ঠিক আছে, সেখানে গেলে কিছু পয়সাপাতি হয়। কিন্তু অনেককেই আমি দেখেছি ভবঘুরের মতো ফিরছে। কোনো চাকরি পাচ্ছে না। কেউ হোটেলে ম্যাসিয়ার-বয় হয়ে থাকে। কেউ থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করে। যতকিছুই কর- গ্রিনকার্ড নাও বা ন্যাশনালিটি পেয়ে যাও, তোমাকে সেই থার্ড রেটেই থাকতে হবে। অতএব তুমি যেটাকে সম্মান মনে করছ তা হাছিল করেও তুমি সেই ইজ্জত পাবে না, যা ওখানকার স্থানীয়রা পেয়ে থাকে।
যারা চলে গেছে তো গেছেই। আল্লাহ তাআলা তাদের হেফাযত করুন। আমরা চেষ্টা করি সেখানে এমন হালকা কায়েম হোক যেখানে দ্বীনী আলোচনা হবে। এমন মজলিস হোক যেখানে তারা দ্বীনী খোরাক পাবে। আলহামদু লিল্লাহ, তাবলীগ জামাতের কাজ সব জায়গায় রয়েছে। এর মাধ্যমেও খুব ফায়দা হচ্ছে।
এগুলো আছে- ঠিক আছে।
কিন্তু কেউ সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করবে এবং এমন মনোভাব যে, যদি যেতে পারে তাহলে যেন জান্নাত পেয়ে গেছে- এটা চরম বেগায়রতীর কথা। এরকম মনোভাব নিজের এবং নিজের প্রজন্মকে ধ্বংস করার নামান্তর। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন।
এই কিছু শিক্ষা আল্লাহ তাআলা এবারের সফরে দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা এ কথাগুলো বোঝার এবং সে মোতাবেক জীবন পরিচালিত করার তাওফীক দান করুন।
আমি মুনাজাতে মাকবুলের দুআসমূহ নিয়ে আলোচনার একটা সিলসিলা চালু করেছিলাম। আগামী মজলিস থেকে আবার সেই ধারা চালু হবে- ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা সকলের জন্য তা উপকারী বানিয়ে দিন- আমীন। হ
[তরজমা : মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর]