প্রসঙ্গ : কুরবানীর গোশত বিতরণ

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

কুরবানীর দিন দুপুরের পর থেকে একটা সাধারণ দৃশ্য সকলেরই চোখে পড়ে। কুরবানীদাতার বাড়ির দরজায় একদল মানুষের ভিড়। তাদের কেউ একা এবং কেউ পরিবারসহ। কেউ পেশাদার ভিক্ষুক এবং কেউ গরীব কর্মজীবি, যার নিজের কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আজ তারা সবাই এক কাতারে। কুরবানীর গোশত সংগ্রহের জন্য তারা দলে দলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কুরবানীদাতা নিজে বা তার পক্ষ থেকে কোনও লোক তাদের হাতে হাতে এক-দুই টুকরা করে গোশত বিতরণ করছে। হাতে গোশত বিতরণ করছে আর মুখে কাউকে ধমকাচ্ছে, কাউকে বকছে, কাউকে তাড়া করছে এবং কারও উদ্দেশ্যে বিশেষ কোনও মন্তব্য করছে।

এ দৃশ্য কতটা সুখকর? কুরবানী একটি মহান ইবাদত। তার সাথে এ দৃশ্য খাপ খায় কি? কুরবানী করা ওয়াজিব, এর গোশত বিতরণ সুন্নত এবং এর গোশত খাওয়াও সুন্নত। ঈদুল আযহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতটির নামে। আল্লাহ তাআলা এ দিন নামায আদায়ের পাশাপাশি কুরবানী করারও হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ.

সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামায পড় ও কুরবানী দাও। -সূরা কাউসার (১০৮) : ২

প্রথমে নামাযের হুকুম, তারপর কুরবানীর। যেন বলা হচ্ছে- নামাযের মাধ্যমে প্রথমে আল্লাহর সামনে আত্মনিবেদিত হও, তারপর সে আত্মনিবেদনের নিদর্শনস্বরূপ কুরবানী কর। এজন্যই কুরবানী করতে হয় ঈদের নামায আদায়ের পর, তার আগে নয়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

مَنْ كَانَ ذَبَحَ قَبْلَ الصّلَاةِ فَلْيُعِدْ.

কেউ নামায আদায়ের আগে যবাহ করলে সে যেন (নামাযের পর) পুনরায় যবাহ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬২; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৯৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৫৩

যেহেতু এ যবাহ কেবলই আল্লাহর উদ্দেশ্যে, সে হিসেবে এর গোশত কারও জন্যই খাওয়া জায়েয হওয়ার কথা ছিল না, কিংবা আর সকলের জন্য খাওয়া জায়েয হলেও কুরবানীদাতার জন্য খাওয়ার অনুমতি থাকার কথা নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বড়ই মেহেরবান। তিনি এটা সকলের জন্যই খাওয়া বৈধ করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন-

فَكُلُوْا مِنْهَا وَاَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ، كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। -সূরা হজ্ব (২২) : ১৩৬

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন-

كُلُوْا وَادّخِرُوْا وَتَصَدّقُوْا.

তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং দান-খয়রাত কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৪৪২৬; মুআত্তা মালিক, হাদীস ২১৩৫

এভাবে কুরবানীর গোশত নিজে খাওয়ার এবং অন্যকে খাওয়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। সমস্ত মুসলিম এ দিনগুলোতে আল্লাহর মেহমান। তাঁর জন্য নিবেদিত পশুর গোশত তিনি মুসলিমদের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন, যাতে তারা তা খেয়ে খেয়ে তাঁর অনুগ্রহের শুকর আদায় করে। আল্লাহ তাআলার যিয়াফত ও আতিথেয়তা গ্রহণ করার মধ্যেই বন্দেগীর মাহাত্ম্য। কাজেই কুরবানীর গোশত খাওয়া উদরপূর্তিমাত্র নয়; বরং এর মধ্যে রয়েছে ইবাদতের মহিমা। আর এর গোশত বিতরণও নয় গরীবের প্রতি করুণা; বরং এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যিয়াফতের প্রতিনিধিত্ব। কুরবানীদাতা যেন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের মেহমানদারী করছে। তো এটা ইবাদত ছাড়া আর কী? ইবাদত বলেই গোশত বিতরণে এ নিয়মকে মুস্তাহাব করে দেওয়া হয়েছে যে, সবটা গোশত তিন ভাগ করা হবে। তার এক ভাগ নিজেরা খাওয়া হবে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়া হবে আর এক ভাগ দেওয়া হবে গরীব-মিসকীনদের।

সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কুরবানীর পশু জবাই, তার গোশত বিতরণ ও গোশত খাওয়া সবটাই ইবাদত। ইবাদত করার দ্বারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ হয় ও বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়। কুরবানীর আদ্যোপান্ত যখন ইবাদত, তখন এর দ্বারাও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব অর্জিত হবে বৈ কি। তা হবে কুরবানীর পশু যবাহ করার দ্বারা, তার গোশত খাওয়ার দ্বারা এবং গোশত বিতরণ করার দ্বারা। তা কত এর ছাওয়াব?

হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনও আমল করতে পারে না, যা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, তার ক্ষুর ও পশমসহ হাজির হবে। যবাহের পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এর দ্বারা মনেপ্রাণে খুশি হয়ে যাও। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫৬৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৬

(قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيب)

অবশ্য এর জন্য শর্ত হচ্ছে ইবাদতটি করা হবে এর জাহিরী ও বাতিনী যাবতীয় রীতি-নীতিসহ। গোশত বিতরণের উল্লিখিত রেওয়াজ ও দৃশ্য সে রীতি-নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি?

ইবাদতে বিনয়-নম্রতা কাম্য। মন থাকবে আল্লাহ অভিমুখী, তাঁর ভয়ে কম্পিত, তাঁর ইশক ও মহব্বতে তাড়িত এবং তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তিতে আপ্লুত। মনের এ ভাবাবেগ অব্যাহত থাকা বাঞ্ছনীয় ইবাদতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা সময়। তবে আমরা দুর্বল। আমাদের আছে নফসের নানারকম উৎপাত। আছে শয়তানের উপর্যুপরি প্ররোচনা। এ অবস্থায় ইবাদতের সঙ্গে মনের গভীর সংযোগ বজায় রাখা আমাদের পক্ষে একটু কঠিনই। অসীম দয়াময় আল্লাহ আমাদের এ দুর্বলতাকে ওযর হিসেবে দেখবেন বলে আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু আমাদের বাহ্যিক ধরন-ধারণও যদি ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, উপরন্তু আমাদের কর্মপন্থা দ্বারা যদি ইবাদতের মহিমা ক্ষুণ্ন হয় আর এ অবস্থায় প্রকাশ্য কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যাই, তবে সত্যিকার অর্থে তা ইবাদত হবে কতটুকু? আমাদের দ্বীন কি এরকম ইবাদতেরই আদেশ আমাদের করেছে? না ইবাদতের নামে এমনসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করা বাঞ্ছনীয়?

যে দৃশ্যের কথা বলা হল, কুরবানীর মহান ইবাদতের সঙ্গে তা আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা গোশত বিতরণের প্রচলিত পদ্ধতি বিনয়নিষ্ঠ নয়। এর মধ্যে আছে অহমিকার আভাস। লোকজন আমার বাড়ির দুয়ারে ছুটে এসেছে। আমার হাত থেকে গোশত নেওয়ার জন্য হাত পেতে রেখেছে। আমি বিরক্তির সাথে দুই-এক টুকরা গোশত সেসব হাতে বিলিয়ে যাচ্ছি কিংবা সাগ্রহে বিতরণ করে দুর্বলের প্রতি করুণা করার অহমবোধে আপ্লুত হচ্ছি। এ ভাবধারা আর যাই হোক, মহান ইবাদতের সাথে খাপ খায় না। ইবাদতকালে মনের ভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

وَ الَّذِیْنَ یُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰی رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَ.

আর যারা যা দেওয়ার তা দেয় ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এজন্য যে, তাদেরকে নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে -সূরা মু’মিনূন  (২৩) : ৬০

আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে-কোনও ইবাদত ও যে-কোনও দান-বিতরণ এরকম ভীত-কম্পিত মনেই হওয়া উচিত। এটাই ইবাদতের প্রাণশক্তি।

হাঁ, ইবাদতের প্রাণশক্তি হচ্ছে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি। নামায, রোযাসহ প্রতিটি ইবাদতের মধ্যে এ প্রাণশক্তি থাকা অপরিহার্য। মূলত এসব ইবাদতের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলা বান্দার কাছে যা চান তা কেবল তাকওয়াই। কুরবানী সম্পর্কেও আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ .

আল্লাহর কাছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭

যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে, সে তার কাছে আল্লাহর বান্দাদের হাত পাতায় খুশি হতে পারে না। হাদীসে প্রকৃত মুমিন তাকেই বলা হয়েছে, যে নিজের জন্য যা পসন্দ করে, অন্য মুমিনের জন্যও তাই পসন্দ করে থাকে আর নিজের জন্য যা অপসন্দ করে, অন্যের জন্যও তা অপসন্দ করে। কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুমিন অন্যের কাছে হাত পাতা ও অন্যের দুয়ারে ধরনা দেওয়া পসন্দ করে কি? তাহলে সে অন্যের জন্য কেন তা পসন্দ করবে? কেন সে এতে খুশি হবে যে, কুরবানীর গোশতের জন্য তার মুমিন ভাই-বোনেরা তার দুয়ারে এসে ধরনা দেবে? এতে খুশি হওয়া তখনই সম্ভব, যখন সে নিজেকে তাদের তুলনায় বড় মনে করবে। ইবাদত শিক্ষা দেয় নিজেকে সব মুমিন অপেক্ষা ক্ষুদ্র ভাবতে। বিশেষত কুরবানী তো আত্মত্যাগেরই উদ্বোধক। আমিত্ব ত্যাগ ও অহমিকা বিসর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র বান্দারূপে দেখতে না পেলে কুরবানী দ্বারা বিশেষ কী অর্জিত হল? যদি প্রকাশ্যে পশু যবাই হয় অপরদিকে অন্তরস্থ পাশবিকতা হয় আরও পরিপুষ্ট, তবে সে কুরবানী কেবলই অনুষ্ঠানসর্বস্বতা।

ইসলাম মানুষকে আনুষ্ঠানিক বানাতে আসেনি। তার উদ্দেশ্য আপন শিক্ষায় মানুষের দেহমন বিকশিত করে তোলা। অহমিকা বিলোপ ছাড়া সে বিকাশ কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। বস্তুত কুরবানীর গোশত বিতরণের বর্তমান রেওয়াজ অহমিকার বিলোপ নয়; বরং তার বাড়-বাড়ন্তেই ভূমিকা রাখে। সে কারণে এ রেওয়াজ বিলুপ্ত হওয়া উচিত। তা হবে তখনই, যখন কুরবানীদাতা তার কুরবানীর গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

কুরবানীর গোশত নিয়ে মুসলিম ভাই-বোনদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ানো বিনয়-ন¤্রতার পরিচায়ক। এটা অহমিকা নিরাময়ের এক কার্যকরী ওষুধও বটে। আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এক পোটলা গোশত নিয়ে নিজে মুসলিম ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া আর গোশতের আশায় কুরবানীদাতার দুয়ারে সে ভাইয়ের হাজির হওয়া কিছুতেই এক কথা নয়। প্রথম পন্থায় গোশত বিতরণ ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এর দ্বারা আল্লাহর বান্দার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করা হয়, তার সামনে নিজ বিনয়-ন¤্রতা প্রকাশ করা হয় এবং তার প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও মমত্বের আচরণ করা হয়। এসবই তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতাপূর্ণ কাজ, যা কিনা ইবাদতের সারবস্তু। কুরবানী যখন এক ইবাদত, তখন তার গোশত এভাবেই বিতরণ করা বাঞ্ছনীয়। এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, যারা দুয়ারে দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায় তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেওয়া যাবে না বা দেওয়া জায়েয হবে না। তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেওয়া জায়েয হবে বৈ কি, কিন্তু ইসলাম যে বিনয়, সৌন্দর্য এবং ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধের তা‘লীম দেয়, তার যথার্থ অনুশীলনের জন্য মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিতরণই বাঞ্ছনীয়।

তা বাঞ্ছনীয় আরও এক কারণে। কুরবানীর গোশত বিতরণ যখন একটি ইবাদত, তখন এ বিতরণ কিছুতেই ভিক্ষাদানের মত হওয়া উচিত নয় আর এর গ্রহণও হওয়া উচিত নয় ভিক্ষাগ্রহণের মত। কেননা ইবাদত হচ্ছে পুণ্য ও মহত্ব, আর ভিক্ষা করা পাপ ও ক্ষুদ্রতা। ভিক্ষাকে বৃত্তি বানানো ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। প্রচলিত অনেক ধর্মে এটা একটা মহৎ কাজ হলেও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও আত্মনিবেদনের শিক্ষাসম্পন্ন ইসলামে এর বৈধতা অস্বীকৃত। ভিক্ষাবৃত্তির বৈধতা তো দূরের কথা, সাময়িকভাবেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারও কাছে হাত পাতার ইজাযত দেননি। তিনি বরং সাহাবায়ে কিরামের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, যেন তারা কখনও কারও কাছে হাত না পাতেন। এ প্রতিশ্রুতি তারা অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে উটের পিঠে থাকা অবস্থায় হাত থেকে লাঠিটি পড়ে গেলে তাও তুলে দেওয়ার জন্য কাউকে অনুরোধ করেননি। নিজের কাজ নিজে করা হবে, নিজ অন্ন-বস্ত্র সংস্থানের জন্য নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে, কোনওক্রমেই অন্যের গলগ্রহ হওয়া যাবে না এবং অলস সময় কাটানো নয়, সদা কর্মব্যস্ত থাকা হবে- এ শিক্ষাই ইসলাম আমাদের দিয়েছে।

যে ভিক্ষাবৃত্তিকে ইসলাম জায়েয রাখেনি এবং সাময়িকভাবে হলেও যে হাত পাতাকে ইসলাম পসন্দ করেনি, একজন মুসলিম নিজে তো কোনওক্রমে তা করবেই না; বরং অন্য কেউ তা করুক তাও তার কাছে কাম্য হতে পারে না। সুতরাং এ জাতীয় কর্মকা-কে একজন প্রকৃত মুসলিম আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না, তাই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এ কি অবস্থা যে, আমাদের সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি ও মওসুমী হাত পাতার ব্যাপারটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেল! আবার সে রেওয়াজ পবিত্র ইবাদতের অনুষঙ্গ হয়ে উঠল। ইবাদতের মওসুমে এখন ভিক্ষাদান ও ভিক্ষাগ্রহণের বাড়তি শোরগোল। ইবাদতের কেন্দ্রসমূহ বা কেন্দ্রের চত্বরগুলো আজ ভিক্ষা লেনদেনের জমজমাট বাজারে পরিণত।

আজ মসজিদের দরজায় ভিক্ষুকের ভিড়। জুমু‘আ, শবে বরাত এবং রমযান ও শবে কদরে তাদের বাড়তি দৌড়ঝাঁপ। তারাই যাকাত, ফিতরার অর্থ ও কুরবানীর গোশত বিতরণের ক্ষেত্র। যাকাতদাতা ঢাকঢোল পিটিয়ে ফকীর জড়ো করছে। ফিতরাদাতা তার দুয়ারে বা মসজিদের দরজায় ফকীর খুঁজছে। কুরবানীদাতার দুয়ারে কুরবানীর গোশত নিয়ে কাড়াকাড়ি হচ্ছে। অথচ যাকাত-দান ইসলামের প্রধান চার ইবাদতের একটি। ফিতরাও একটি অবশ্যপালনীয় ইবাদত। কুরবানী সম্পর্কে সকলের জানা যে, এটি একটি মহান ইবাদত এবং আমাদের মহান পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস-সালামের আল্লাহপ্রেম ও অকল্পনীয় ত্যাগের স্মারক। এর প্রত্যেকটি পালন করার কথা গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তি ও পরম আল্লাহভীতির সঙ্গে। সে শ্রদ্ধাভক্তি ও আল্লাহভীতির সঙ্গে কোনওরকম ভিক্ষাবৃত্তির কলঙ্ক যুক্ত হবে কেন? কেনই বা হাত পাতার মলিনতায় তা আচ্ছন্ন হবে? কথা তো ছিল যাকাতদাতা নিজে খুঁজে বেড়াবে, কোথায় আছে ধনীর পাঁচশ’ বছর আগে জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদপ্রাপ্ত সেই গরীব মুসলিম, যার হাতে সে গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে যাকাতের অর্থ তুলে দেবে এবং এভাবে তা তুলে দিতে পেরে নিজেকে একজন সৌভাগ্যবান গণ্য করবে। ফিতরাদাতা পৌঁছে যাবে তার অসচ্ছল মুসলিম ভাইয়ের দুয়ারে আর তার হাতে ফিতরার অর্থ আদায় করে আল্লাহর কাছে কবূলিয়াতের আশাবাদী হবে। কুরবানীদাতা কুরবানীর গোশত যেমন মহব্বত ও আন্তরিকতার সাথে নিজ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে পৌঁছায়, তেমনি অভাবগ্রস্তদের বাড়িতেও গুরুত্বের সঙ্গে তা পৌঁছিয়ে দেবে আর মনে ভয় রাখবে, পাছে তার কোনও ত্রুটির কারণে এ বিতরণ আল্লাহ তাআলার কাছে অগ্রাহ্য হয়ে যায়।

কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ যে গরীবদের দিতে বলা হয়েছে, আমরা যেন তার অর্থ করে নিয়েছি প্রচলিত অর্থে যারা ফকীর-মিসকীন তাদেরকে দেওয়া। অর্থাৎ যারা মানুষের দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায় তাদেরকে। অস্বীকার করব না যে, তারাও একটি খাত। কিন্তু আপত্তি হয় তখনই, যখন দুয়ারে ধরনা না দেওয়া গরীব নর-নারীর কোনও খবর নেওয়া হয় না আর তাদের বাড়িতে গোশত পৌঁছানোর চেষ্টা না থাকায় কুরবানীর দিন হয় তারা কুরবানীর গোশত খাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে, নয়তো ফকীর-মিসকীনদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে নিজ ছেলেমেয়েদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে। প্রকৃতপক্ষে সেটা তো কুরবানীর গোশত খাওয়া হল না। এটা অন্য সময়ের বাজার থেকে কেনা গোশতের মতই হল। এটা আমাদের অবহেলারই অনিবার্য ফল যে, একদিকে প্রকৃত গরীবের একাংশ কুরবানীর দিন কুরবানীর গোশত খেতে পায় না আর অপর এক অংশ কুরবানীদাতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ানোর প্ররোচনা পায় আর এভাবে ভিক্ষাকর্মের বাড়-বাড়ন্ত হয়, যা কিছুতেই কাম্য ছিল না।

আজ কুরবানীর গোশত সম্পর্কেও বলতে হচ্ছে যে, তা গরীব ও অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেওয়া চাই, যে কুরবানী করাই হয় ত্যাগের মানসিকতায় এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব লাভের আশায়। অথচ আমাদের ঐতিহ্য ছিল কতই না উচ্চমার্গীয়। একদা আমরা এই মুসলিম উম্মাহ্ সাধারণ দান-অনুদান ও সাহায্য-সহযোগিতাও মানুষের দ্বারে-দ্বারে পৌঁছে দিতাম। এ ঐতিহ্যের উদ্বোধন হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে এবং তাও তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগেই। নবুওয়াতের গুরুভারে তিনি যখন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত, তখন আম্মাজান খাদীজা রা. তো সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে সান্ত¡না যুগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আল্লাহ তাআলা কিছুতেই আপনাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দিতে পারেন না, কিছুতেই তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করতে পারেন না। কারণ আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, আয়-রোজগারে যারা অক্ষম তাদের ভার বহন করেন, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের রোজগার করে দেন, অতিথির সেবা করেন এবং বিপন্ন মানুষের সাহায্য করেন। নবুওয়াতপ্রাপ্তির পরও তাঁর এ কল্যাণধারা অব্যাহত থেকেছে; বরং তা প্রবাহিত হয়েছে আরও প্রবল বেগে। তাঁর পর তাঁর খলীফাগণও সেবার প্রেরণায় মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. ও হযরত উমর ফারূক রা.-এর এ জাতীয় ঘটনাবলী জগৎজোড়া মশহুর। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কার কী সমস্যা, কার কী প্রয়োজন। যার প্রয়োজন এবং যার অভাব, সে কখন তাঁর দুয়ারে এসে হাত পাতবে সে অপেক্ষা তাঁরা করতেন না। এভাবেই চলেছে যুগ যুগ। তাঁদের উত্তরসূরীগণ এ আদর্শের চর্চায় কখনও কসুর করেননি। এমনকি এই অধঃপতন ও অবক্ষয়ের যুগেও অনেকে আছেন, যারা বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে যান এবং সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছে যান। আজও এরকম লোকের সন্ধান মেলে, যারা কুরবানীর গোশত নিয়ে নিজ বাড়িতে বসে থাকে না; বরং যারা কুরবানী দিতে পারে না, গভীর মমতার সাথে তাদের জীর্ণ কুটিরে তা পৌঁছে দেয়। আমরা তাদের থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

এতটুকু কষ্ট আমরা আনন্দের সঙ্গেই করতে পারি যে, আপন এলাকায় কারা কারা কুরবানী দেয় না বা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না তার খোঁজ নেব এবং আগে থেকেই তাদের একটা তালিকা তৈরি করে রাখব। তারপর কুরবানীর দিন সে তালিকা অনুযায়ী কুরবানীর গোশত তাদের বাড়ি পৌঁছে দেব।

দরকার এ ব্যাপারে গণসচেতনতা তৈরির। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাদের চিন্তা-চেতনায় প্রচলিত পদ্ধতিতে গোশত বিতরণের কী ক্ষতি এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিতরণের কী ফায়দা তা যদি সঞ্চার করে দেওয়া যায়, তবে আমরা সহজেই আমাদের হারানো ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারি। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাগণ যদি আগে থেকেই তালিকা তৈরি করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী কুরবানীর গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়, তবে কুরবানীর দিন আঁকা হয়ে যেতে পারে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, যেখানে থাকবে না কুরবানীদাতার বাড়ির দরজায় ফকীর-মিসকীন ও গরীব-দুঃখীর ভিড়; বরং কুরবানীদাতা বা তার লোকজনকেই দেখা যাবে গরীব-মিসকীনদের বাড়িতে বাড়িতে ছোটাছুটি করছে। সেখানে গোশত বিতরণে ভিক্ষাদানের দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং তাতে ইবাদতের মহিমা ভাস্বর হয়ে আছে এবং কুরবানীদাতা অনুভব করছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অভাবগ্রস্ত ভাইদের যিয়াফত করতে পারার অমলিন আনন্দ।

وصلى الله تعالى على سيدنا ونبينا محمد وعلى آله وصحبه وبارك وسلم.

 

পরিশিষ্ট : হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় কুরবানীর হাকীকত ও রূহ বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি আমাদের সমাজে প্রচলিত অথচ সংশোধনযোগ্য একটি প্রথা চিহ্নিত করে দিয়েছেন।

এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা যে, নিজ নিজ এলাকা ও মহল্লায় যারা কুরবানী দিতে অক্ষম তাদের তালিকা প্রস্তুত করা। যাতে ইকরাম ও সম্মানের সঙ্গে তাদের ঘরে ঘরে গোশত পৌঁছে দেয়া যায়।

আরো সহজতার জন্য এমনও করা যেতে পারে যে, কোনো জায়গায়- উদাহরণস্বরূপ মসজিদের সামনে কুরবানীদাতাগণ যে যে পরিমাণ গোশত অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করতে আগ্রহী তা নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দেবেন। এরপর সেখান থেকে তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেকের ঘরে গোশত পৌঁছে দেয়া হবে। শর্ত হল, এক্ষেত্রে কারো ওপর  কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কেউ যদি নিজের অংশ নিজেই প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চায় সে সুযোগ যেন থাকে; তাকে এখানে জমা করতে বাধ্য করা যাবে না। আর এখানে যারা জমা করবে তাদেরকে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ জমা দিতে বাধ্য করা যাবে না। মোটকথা, যা-ই করা হবে এবং যতটুকুই করা হবে, প্রত্যেকে সন্তুষ্টচিত্তে ও স্বতস্ফূর্তভাবে করবে।

বিভিন্ন এলাকায় কুরবানীর গোশত বিতরণের ক্ষেত্রে আরো কিছু প্রথা চালু আছে, যেগুলো সংশোধনযোগ্য। যেমন :

এক. পুরো সমাজের সব কুরাবনীর পশু নির্ধারিত স্থানে জবাই করা। শুধু এতটুকুতে তো সমস্যা ছিল না। ইনতিজামের খাতিরে এমন করতে কোনো বাধা নেই। সমস্যা হল, প্রত্যেক কুরবানীর একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে বিতরণের জন্য নিয়ে নেয়া হয়। এরপর সেগুলোকে একত্র করে সমানভাবে ভাগ করে সমাজের প্রত্যেককে অর্থাৎ যারা কুরবানী করেছে আর যারা করেনি সবাইকে একেক অংশ দিয়ে দেওয়া হয়। এটা গলদ তরিকা। যা অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। এ সম্পর্কে আলকাউসারে (ডিসেম্বর সংখ্যা, ২০০৭ঈ., পৃষ্ঠা ৩৩-৩৫) বিস্তারিত লেখা হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণ তা মুতালাআ করতে পারেন।

দুই. নিজেদের কুরবানীর বাইরে সমাজের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক পশু কুরবানী করা, যাতে সমাজের সকল কুরবানীদাতার অংশগ্রহণ করা জরুরি। এরপর সেগুলোর গোশত সমাজের অসামর্থ্যবান লোকদের ঘরে পৌঁছে দেওয়া।

এই পদ্ধতিও সংশোধনযোগ্য। কারণ যে কোনো আমল, যার বিষয়ে শরীয়ত শুধু তারগীব ও উৎসাহ প্রদান করেছে এবং তা পালন করা মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছে, এমন কাজকে সমাজের পক্ষ থেকে এমনভাবে আবশ্যকীয় বানিয়ে দেওয়া যে, শুধু সামাজিক চাপের কারণে মানুষ তা করতে বাধ্য হয়- শরীয়তের দৃষ্টিতে এমনটা করা বৈধ নয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, কুরবানীর ক্ষেত্রে অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের খেদমত করার একটি সূরত এটাও যে, যাদের তাওফীক আছে তারা কুরবানীর পশু ক্রয় করে অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের দিয়ে দিবে। তারা নিজেরা কুরবানী করবে। কিংবা তাদেরকে অর্থ দিয়ে দেবে। আর তারা নিজেরা পশু ক্রয় করে কুরবানী করবে।

কেউ কেউ তাদের নফল কুরবানী (পশু কিংবা তার মূল্য) অসামর্থ্যবান ব্যক্তিদের হাতে দিয়ে তাদেরকেই এর গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়ে দেয়। এই সূরতও জায়েয। তবে তার চেয়ে ভালো পদ্ধতি হল, কুরবানীটাই যেন তাদের পক্ষ থেকে হয় সে সুযোগ করে  দেয়া। অর্থাৎ পশু কিংবা তার মূল্য তাদেরকে হাদিয়া বা সদকা দিয়ে দেওয়া।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরবানীসহ সকল ইবাদত ইখলাসের মাধ্যমে পবিত্র করার এবং সুন্নতের মাধ্যমে আলোকিত ও বরকতপূর্ণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন। -বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক